ঢাকা ০৩:৫৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পিবিআইয়ের গবেষণায় ৫২ শতাংশ মামলায় সব আসামি খালাস, কারণ কী

  • ঢাকা প্রতিনিধী
  • প্রকাশের সময় : ১১:১৯:৪৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৫
  • ২৩১ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহিত

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হামলা, পারিবারিক বিরোধ, শত্রুতা কিংবা ডাকাতি-ছিনতাই; কারণ যা-ই হোক না কেন, খুনের ঘটনায় করা ৫২ শতাংশ মামলায় আসামিরা খালাস পান। অন্যভাবে বলা যায়, দেশে খুনের ঘটনায় যত মামলা হয়, তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি মামলায় শেষ পর্যন্ত আসামিদের কোনো সাজা হয় না।

কিছু ক্ষেত্রে খুনের মামলায় আসামিরা ধরা পড়ার পর হয়তো সাময়িকভাবে জেলে যান, কিন্তু বিচার শেষে খালাস পেয়ে যান তাঁরা। পুলিশের গবেষণাতেই এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

‘হত্যা মামলার সাজার হার কম হওয়ার কারণ অনুসন্ধান’ শীর্ষক এই গবেষণা করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। চলতি বছরের মে মাসে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে পিবিআই।কিছু ক্ষেত্রে খুনের মামলায় আসামিরা ধরা পড়ার পর হয়তো সাময়িকভাবে জেলে যান, কিন্তু বিচার শেষে খালাস পেয়ে যান তাঁরা। পুলিশের গবেষণাতেই এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

  • বাদী এবং বিবাদীর সমঝোতার কারণে সবচেয়ে বেশি মামলার আসামিরা খালাস পান
  • মামলার এজাহারের দুর্বলতা
  • তদন্তে ত্রুটি
  • তদন্তে দীর্ঘ সময় নেওয়া
  • তদন্ত কর্মকর্তার অদক্ষতা ও প্রভাবিত হওয়া
  • এজাহার, সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে মিল না থাকা
  • ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে অসংগতি
  • রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো
  • সাক্ষীদের আদালতে হাজির করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা
  • সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখানো
  • জবানবন্দি সঠিকভাবে না নেওয়া

আরও বিভিন্ন কারণে অনেক মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন। এ ছাড়া বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণেও অনেক ক্ষেত্রে আসামি খালাস পেয়ে যান।

পিবিআইয়ের গবেষণায় ২৩৮টি খুনের মামলা পর্যালোচনা করা হয়েছে। এসব মামলার রায় হয়েছে ২০১৫ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে। মামলাগুলো হয়েছিল ১৯৮৬ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে। এর মধ্যে ১২৩টি মামলায় সব আসামি খালাস পেয়েছেন। ১১৫টি মামলায় আসামিদের সাজা হয়েছে।

গবেষণার জন্য যেসব মামলা বিশ্লেষণ করেছে পিবিআই, তার মধ্যে রয়েছে সম্পত্তি ও পারিবারিক বিরোধের কারণে খুন। মাদক ব্যবসা ও জুয়ার টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে খুন, আর্থিক লেনদেনের বিরোধ থেকে খুন, ডাকাতি-ছিনতাইকালে খুনের ঘটনা এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর হামলা ও দলীয় কোন্দলের কারণে খুন।

খুনের মামলায় সাজার হার কম কেন, সেটি খুঁজে বের করতেই গবেষণাটি করা হয়েছে বলে জানান পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ও পিবিআইয়ের প্রধান মোস্তফা কামাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাজার হার কম হওয়ার কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। মামলার তদন্ত থেকে শুরু করে বিচার পর্যন্ত কোন কোন পর্যায়ে কার কী দুর্বলতা, সেগুলো গবেষণায় উঠে এসেছে। এগুলো দূর করা গেলে সাজার হার বাড়বে এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা ন্যায়বিচার পাবেন।

পিবিআই যেসব মামলার তথ্য নিয়ে কাজ করেছে, তার একটি সিলেটের। জেলার গোয়াইনঘাটের ফতেপুরে ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট মসজিদের পুকুরপাড়ে পুরোনো একটি কাঁঠালগাছ কাটা নিয়ে সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষে ফয়জুর রহমান নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা নিহত হন। এ ঘটনায় তাঁর স্বজনেরা পাঁচজনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন।

মামলার এক বছর পর থানা-পুলিশ তদন্ত করে পাঁচজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয়। ২০১৫ সালে মামলার রায় হয় এবং সব আসামি খালাস পান। রায়ে আদালত বলেছেন, সাক্ষীরা এজাহার সমর্থন করে বক্তব্য দেননি। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, বাদীপক্ষ ও বিবাদীপক্ষ আদালতের বাইরে সমঝোতা করে থাকতে পারে।

সাজার হার কম হওয়ার কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। মামলার তদন্ত থেকে শুরু করে বিচার পর্যন্ত কোন কোন পর্যায়ে কার কী দুর্বলতা, সেগুলো গবেষণায় উঠে এসেছে। এগুলো দূর করা গেলে সাজার হার বাড়বে এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা ন্যায়বিচার পাবেন।

পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ও পিবিআইয়ের প্রধান মোস্তফা কামালপিবিআই গবেষণার জন্য যেসব মামলা বিশ্লেষণ করেছে, তার মধ্যে ২০১২ সালের ঘটনাও রয়েছে। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে বগুড়া শহরে নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে খুন হন স্বেচ্ছাসেবক লীগের (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) নেতা খায়রুল আনাম। দলীয় কোন্দলে খুন হওয়ার বিষয়টি তখন পরিবারের সদস্যরা বলেছিলেন। খুনের ঘটনার এক দশক পর ২০২২ সালে আদালতের রায়ে এ মামলার ১৩ আসামির সবাই খালাস পান।

এই মামলার তথ্য পিবিআইয়ের গবেষণা নমুনায় ছিল না। কিন্তু আসামি খালাসের বিষয়ে পিবিআই যেসব কারণ উল্লেখ করেছে, তার সঙ্গে মামলার বাদীর বক্তব্য মিলে যায়। নিহত খায়রুল আনামের বাবা আবদুল কাইয়ুমের সঙ্গে গত জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, মামলার তদন্ত নিয়ে তাঁদের অসন্তুষ্টি ছিল। এ ছাড়া আসামিদের হুমকির কারণে অনেক সাক্ষী আদালতে যাননি।

খুনের মামলায় আসামি খালাসের পেছনে তদন্তের দুর্বলতা, সাক্ষীদের হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানোর বিষয়টি পিবিআইয়ের বিশ্লেষণেও উঠে এসেছে।পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে (২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল) দেশে খুন হয়েছেন ৬০ হাজার ৩৭ জন। সে হিসাবে দেশে বছরে খুন হন ৩ হাজার ৭৫২ জন।

বাদী-বিবাদীর সমঝোতায় বেশি খালাস

পিবিআইয়ের গবেষণা অনুযায়ী, যে ১২৩টি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন, এর মধ্যে ৪৭টিতে বাদী-বিবাদীর মধ্যে আপস বা সমঝোতা হয়েছিল। তদন্তের ত্রুটি ও সাক্ষীকে বৈরী ঘোষণা করার কারণে ৩২টি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন। শুধু তদন্তে ত্রুটির কারণে আসামিরা খালাস পেয়েছেন ১৪টি মামলা থেকে।

১১টি মামলায় আসামিরা খালাস পাওয়ার পেছনে বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছে পিবিআই। এর মধ্যে রয়েছে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে অসংগতি, সাক্ষীকে বৈরী ঘোষণা, সাক্ষীর অনুপস্থিতি ও তদন্তের ত্রুটি। ম্যাজিস্ট্রেটের ভুলের কারণে ৪টি মামলায় খালাস পেয়েছেন আসামিরা। এ ছাড়া ১৫টি মামলায় অপরাধ প্রমাণ করা যায়নি।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে (২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল) দেশে খুন হয়েছেন ৬০ হাজার ৩৭ জন। সে হিসাবে দেশে বছরে খুন হন ৩ হাজার ৭৫২ জন।

দণ্ডবিধি অনুযায়ী খুনের মামলায় সমঝোতার সুযোগ নেই। কিন্তু খুনের অনেক ঘটনায় গোপনে সমঝোতার পর বাদী এবং সাক্ষীরা আদালতে গিয়ে মিথ্যা সাক্ষী দেন। এ ধরনের সাক্ষীকে বৈরী ঘোষণা করে রাষ্ট্রপক্ষ বিচার চলমান রাখে। কারণ, বাদী-বিবাদী সমঝোতা করলেও হত্যার বিচার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিচারক বুঝতে পারেন সাক্ষীরা মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিচারকের কিছু করার থাকে না। একপর্যায়ে আসামিদের মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে রায় দেন বিচারক।

ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার ৩০টি খুনের (২০১০-২০২৪ সাল) মামলার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গত বছরের ২৬ জুন  ‘এক উপজেলায় ১৪ বছরে ৯০ খুন, হত্যা মামলায়ও সমঝোতা হয়’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। এতে দেখা যায়, খুনের ৩০টি ঘটনার মধ্যে ১২টিতেই বাদী-বিবাদী সমঝোতা করেছিলেন। খুনের আটটি ঘটনায় করা মামলার বাদীরা প্রথম আলোকে বলেছেন, রাজনৈতিক চাপে তাঁরা সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছেন। প্রতিটি ঘটনাতেই টাকার লেনদেন হয়েছে। এর মানে হলো খুনের ঘটনাতেও সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপে অনেক ক্ষেত্রে বাদী সমঝোতা করতে বাধ্য হন।

তদন্তে ত্রুটি

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় ২০২২ সালে প্রবাসী ইউসুফ আলী হত্যার ঘটনাটি ব্যাপক আলোচিত ছিল। ২০২৪ সালে এই মামলার রায়ে ১২ আসামির সবাই খালাস পেয়েছেন। বড় ভাইয়ের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধের জেরে ছোট ভাই ইউসুফ আলীকে খুন করে প্রতিপক্ষের লোকজন।

তদন্ত কর্মকর্তার ভুলের কারণে এই মামলার আসামিরা খালাস পেয়েছেন বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের সাবেক কৌঁসুলি অশোক কুমার দাশ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আলামত জব্দ ও তদন্তের ক্ষেত্রে কিছু ত্রুটির কথা উল্লেখ করে আদালত সবাইকে খালাস দিয়েছেন। তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনাস্থলের বর্ণনা ঠিকমতো তুলে ধরতে পারেননি। এ কারণে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতেও বলেন আদালত।

খুনের বিভিন্ন মামলায় তদন্তের ত্রুটির বিষয়ে পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তদন্ত কর্মকর্তার অদক্ষতা, আন্তরিকতার অভাব এবং অতিরিক্ত কাজের চাপের পাশাপাশি তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়হীনতাও দায়ী। তদন্ত কর্মকর্তাকে কার্যকর পরামর্শ দেওয়ার জন্য একটি মনিটরিং টিম (তদারকি দল) থাকা প্রয়োজন বলে সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ ছাড়া তদন্তে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়ারও সুপারিশ করেছে পিবিআই।

ফৌজদারি অপরাধের মামলা তদন্তের জন্য পুলিশের বাইরে পৃথক সংস্থা গঠন করার প্রস্তাব করেছে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, তদন্তের জন্য গঠিত সংস্থাকে হতে হবে দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য, যাতে প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে।বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন মনে করে, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় তদন্ত একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। তদন্ত কর্মকর্তা সৎ, সাহসী, দক্ষ ও পেশাদার না হলে তদন্ত প্রতিবেদনে নানা রকম দুর্বলতা থেকে যায়।

বর্তমান ব্যবস্থায় খুনসহ বিভিন্ন ফৌজদারি অপরাধের ঘটনা তদন্ত করে পুলিশ। থানা-পুলিশের পাশাপাশি তদন্তের জন্য পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) রয়েছে। তবে এসব ইউনিট পুলিশের অধীনে পরিচালিত হয়। নিয়োগ হয় পুলিশ থেকে বদলির মাধ্যমে। কমিশনের প্রস্তাব হচ্ছে, পৃথক তদন্ত সংস্থার জনবল পুলিশ বাহিনী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হবে। তাঁদের নিয়োগ, চাকরির শর্ত, বাজেট, অবকাঠামো ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি একটি স্বতন্ত্র সংগঠন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোভুক্ত হবে। সাধারণভাবে প্রস্তাবিত সংস্থা কাজ শুরু করবে মামলা দায়েরের পর থেকেই।

বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন মনে করে, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় তদন্ত একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। তদন্ত কর্মকর্তা সৎ, সাহসী, দক্ষ ও পেশাদার না হলে তদন্ত প্রতিবেদনে নানা রকম দুর্বলতা থেকে যায়। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবসহ নানা কারণে যথাযথভাবে প্রকৃত তথ্য প্রতিফলিত হয় না।

দ্রুত ও মানসম্পন্ন তদন্তের ওপর মামলার ফলাফল অনেকাংশে নির্ভরশীল।সাজাপ্রাপ্ত মামলাগুলোর (১১৫টি) ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তদন্তে পুলিশ সময় নিয়েছে গড়ে ১ বছর ২ মাস। আর বিচারিক কার্যক্রমে সময় লেগেছে ১০ বছর ৩ মাস। অন্যদিকে খালাস পাওয়া মামলাগুলোর ক্ষেত্রে পুলিশ তদন্তে সময় নিয়েছে ১ বছর ৪ মাস এবং বিচারিক কার্যক্রমে সময় লেগেছে ১১ বছর ৬ মাস।

বিচারে দীর্ঘসূত্রতা

পিবিআইয়ের গবেষণায় মামলার বিচারের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার বিষয়টিও এসেছে। যে ২৩৮টি মামলার তথ্য পর্যালোচনা করেছে সংস্থাটি, তাতে দেখা গেছে, বিচারকাজে গড়ে প্রায় ১১ বছর সময় লেগেছে। বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে সাক্ষীদের অনুপস্থিতি বা সাক্ষ্য প্রদানে ত্রুটি হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। একইভাবে তদন্তের ক্ষেত্রেও বেশি দেরি হলে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার সঙ্গে মামলা প্রমাণিত না হওয়ার যোগসূত্র থাকে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে পিবিআই।

সাজাপ্রাপ্ত মামলাগুলোর (১১৫টি) ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তদন্তে পুলিশ সময় নিয়েছে গড়ে ১ বছর ২ মাস। আর বিচারিক কার্যক্রমে সময় লেগেছে ১০ বছর ৩ মাস। অন্যদিকে খালাস পাওয়া মামলাগুলোর ক্ষেত্রে পুলিশ তদন্তে সময় নিয়েছে ১ বছর ৪ মাস এবং বিচারিক কার্যক্রমে সময় লেগেছে ১১ বছর ৬ মাস।

পিবিআই প্রতিবেদনে বলেছে, মামলার তদন্ত ও বিচারিক কাজে বেশি সময় নেওয়া হলে সাজা হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কমে আসে।

হত্যা মামলার তদন্তে ও বিচারে দীর্ঘ সময় লাগার বিষয়টি উদ্বেগজনক বলে মনে করে পিবিআই। সংস্থাটি মনে করে, মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে বাদীপক্ষের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নানা কারণে এলাকাছাড়া হন।

আবার অনেক সাক্ষী মারাও যান। দীর্ঘ সময় হলে আসামিপক্ষ হত্যার শিকার হওয়া ব্যক্তির স্বজন ও সাক্ষীদের প্রলোভন অথবা ভয় দেখিয়ে সমঝোতায় বাধ্য করতে পারে।ফৌজদারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাষ্ট্রপক্ষের নিযুক্ত কৌঁসুলির পরামর্শ নিতে পারেন। এমনকি অভিযোগপত্র দেওয়ার আগেও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা নিতে পারেন। সমন্বয় থাকলে মামলার তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করার কাজটি সহজ হবে এবং বিচার দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তি হবে।

বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষীরা সঠিক সাক্ষ্য দেন না। এমন একটি উদাহরণ হচ্ছে চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ে এক ব্যক্তিকে পূর্বশত্রুতার জেরে খুন করা হয়। ঘটনাটি ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসের। এ ঘটনায় করা মামলার রায় হয় ২০১৬ সালে। রায়ে সব আসামিকে খালাস দেওয়া হয়। এই মামলার তদন্তে পুলিশ সময় নিয়েছে ১ বছর ২ মাস। আর বিচারে সময় লেগেছে ১৮ বছর। মূলত বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণে বাদী-বিবাদী সমঝোতা হয়ে যায়। ফলে সাক্ষীরা সঠিক সাক্ষ্য দেননি। সব আসামি খালাস পান বলে পিবিআই তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘বিশেষ প্রসিকিউটোরিয়াল উপদেষ্টা’ এহসানুল হক সমাজী প্রথম আলোকে বলেন, হত্যা মামলার আসামিদের খালাস পাওয়ার ক্ষেত্রে যেসব কারণ পিবিআই উল্লেখ করেছে, এগুলো অমূলক নয়। যেমন সাক্ষ্য–প্রমাণের অভাব, আপসমূলে সাক্ষ্য দেওয়া, সাক্ষী আদালতে না আসা, বিভিন্ন কারণে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা। মামলা প্রমাণ করার জন্য প্রাসঙ্গিক সাক্ষী কারা হবেন, সেটি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে নির্ধারণ করতে হবে। কারণ, মৌখিক ও দালিলিক সাক্ষীর মাধ্যমে অপরাধ প্রমাণ করা না গেলে আসামিরা খালাস পাবেন, এটাই স্বাভাবিক।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, ফৌজদারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাষ্ট্রপক্ষের নিযুক্ত কৌঁসুলির পরামর্শ নিতে পারেন। এমনকি অভিযোগপত্র দেওয়ার আগেও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা নিতে পারেন। সমন্বয় থাকলে মামলার তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করার কাজটি সহজ হবে এবং বিচার দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তি হবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Gojnobi biplob

Popular Post

গাইবান্ধায় মাদক কারবারি গ্রেফতার

পিবিআইয়ের গবেষণায় ৫২ শতাংশ মামলায় সব আসামি খালাস, কারণ কী

প্রকাশের সময় : ১১:১৯:৪৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৫

ছবি সংগৃহিত

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হামলা, পারিবারিক বিরোধ, শত্রুতা কিংবা ডাকাতি-ছিনতাই; কারণ যা-ই হোক না কেন, খুনের ঘটনায় করা ৫২ শতাংশ মামলায় আসামিরা খালাস পান। অন্যভাবে বলা যায়, দেশে খুনের ঘটনায় যত মামলা হয়, তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি মামলায় শেষ পর্যন্ত আসামিদের কোনো সাজা হয় না।

কিছু ক্ষেত্রে খুনের মামলায় আসামিরা ধরা পড়ার পর হয়তো সাময়িকভাবে জেলে যান, কিন্তু বিচার শেষে খালাস পেয়ে যান তাঁরা। পুলিশের গবেষণাতেই এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

‘হত্যা মামলার সাজার হার কম হওয়ার কারণ অনুসন্ধান’ শীর্ষক এই গবেষণা করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। চলতি বছরের মে মাসে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে পিবিআই।কিছু ক্ষেত্রে খুনের মামলায় আসামিরা ধরা পড়ার পর হয়তো সাময়িকভাবে জেলে যান, কিন্তু বিচার শেষে খালাস পেয়ে যান তাঁরা। পুলিশের গবেষণাতেই এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

  • বাদী এবং বিবাদীর সমঝোতার কারণে সবচেয়ে বেশি মামলার আসামিরা খালাস পান
  • মামলার এজাহারের দুর্বলতা
  • তদন্তে ত্রুটি
  • তদন্তে দীর্ঘ সময় নেওয়া
  • তদন্ত কর্মকর্তার অদক্ষতা ও প্রভাবিত হওয়া
  • এজাহার, সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে মিল না থাকা
  • ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে অসংগতি
  • রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো
  • সাক্ষীদের আদালতে হাজির করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা
  • সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখানো
  • জবানবন্দি সঠিকভাবে না নেওয়া

আরও বিভিন্ন কারণে অনেক মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন। এ ছাড়া বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণেও অনেক ক্ষেত্রে আসামি খালাস পেয়ে যান।

পিবিআইয়ের গবেষণায় ২৩৮টি খুনের মামলা পর্যালোচনা করা হয়েছে। এসব মামলার রায় হয়েছে ২০১৫ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে। মামলাগুলো হয়েছিল ১৯৮৬ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে। এর মধ্যে ১২৩টি মামলায় সব আসামি খালাস পেয়েছেন। ১১৫টি মামলায় আসামিদের সাজা হয়েছে।

গবেষণার জন্য যেসব মামলা বিশ্লেষণ করেছে পিবিআই, তার মধ্যে রয়েছে সম্পত্তি ও পারিবারিক বিরোধের কারণে খুন। মাদক ব্যবসা ও জুয়ার টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে খুন, আর্থিক লেনদেনের বিরোধ থেকে খুন, ডাকাতি-ছিনতাইকালে খুনের ঘটনা এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর হামলা ও দলীয় কোন্দলের কারণে খুন।

খুনের মামলায় সাজার হার কম কেন, সেটি খুঁজে বের করতেই গবেষণাটি করা হয়েছে বলে জানান পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ও পিবিআইয়ের প্রধান মোস্তফা কামাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাজার হার কম হওয়ার কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। মামলার তদন্ত থেকে শুরু করে বিচার পর্যন্ত কোন কোন পর্যায়ে কার কী দুর্বলতা, সেগুলো গবেষণায় উঠে এসেছে। এগুলো দূর করা গেলে সাজার হার বাড়বে এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা ন্যায়বিচার পাবেন।

পিবিআই যেসব মামলার তথ্য নিয়ে কাজ করেছে, তার একটি সিলেটের। জেলার গোয়াইনঘাটের ফতেপুরে ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট মসজিদের পুকুরপাড়ে পুরোনো একটি কাঁঠালগাছ কাটা নিয়ে সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষে ফয়জুর রহমান নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা নিহত হন। এ ঘটনায় তাঁর স্বজনেরা পাঁচজনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন।

মামলার এক বছর পর থানা-পুলিশ তদন্ত করে পাঁচজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয়। ২০১৫ সালে মামলার রায় হয় এবং সব আসামি খালাস পান। রায়ে আদালত বলেছেন, সাক্ষীরা এজাহার সমর্থন করে বক্তব্য দেননি। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, বাদীপক্ষ ও বিবাদীপক্ষ আদালতের বাইরে সমঝোতা করে থাকতে পারে।

সাজার হার কম হওয়ার কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। মামলার তদন্ত থেকে শুরু করে বিচার পর্যন্ত কোন কোন পর্যায়ে কার কী দুর্বলতা, সেগুলো গবেষণায় উঠে এসেছে। এগুলো দূর করা গেলে সাজার হার বাড়বে এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা ন্যায়বিচার পাবেন।

পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ও পিবিআইয়ের প্রধান মোস্তফা কামালপিবিআই গবেষণার জন্য যেসব মামলা বিশ্লেষণ করেছে, তার মধ্যে ২০১২ সালের ঘটনাও রয়েছে। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে বগুড়া শহরে নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে খুন হন স্বেচ্ছাসেবক লীগের (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) নেতা খায়রুল আনাম। দলীয় কোন্দলে খুন হওয়ার বিষয়টি তখন পরিবারের সদস্যরা বলেছিলেন। খুনের ঘটনার এক দশক পর ২০২২ সালে আদালতের রায়ে এ মামলার ১৩ আসামির সবাই খালাস পান।

এই মামলার তথ্য পিবিআইয়ের গবেষণা নমুনায় ছিল না। কিন্তু আসামি খালাসের বিষয়ে পিবিআই যেসব কারণ উল্লেখ করেছে, তার সঙ্গে মামলার বাদীর বক্তব্য মিলে যায়। নিহত খায়রুল আনামের বাবা আবদুল কাইয়ুমের সঙ্গে গত জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, মামলার তদন্ত নিয়ে তাঁদের অসন্তুষ্টি ছিল। এ ছাড়া আসামিদের হুমকির কারণে অনেক সাক্ষী আদালতে যাননি।

খুনের মামলায় আসামি খালাসের পেছনে তদন্তের দুর্বলতা, সাক্ষীদের হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানোর বিষয়টি পিবিআইয়ের বিশ্লেষণেও উঠে এসেছে।পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে (২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল) দেশে খুন হয়েছেন ৬০ হাজার ৩৭ জন। সে হিসাবে দেশে বছরে খুন হন ৩ হাজার ৭৫২ জন।

বাদী-বিবাদীর সমঝোতায় বেশি খালাস

পিবিআইয়ের গবেষণা অনুযায়ী, যে ১২৩টি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন, এর মধ্যে ৪৭টিতে বাদী-বিবাদীর মধ্যে আপস বা সমঝোতা হয়েছিল। তদন্তের ত্রুটি ও সাক্ষীকে বৈরী ঘোষণা করার কারণে ৩২টি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন। শুধু তদন্তে ত্রুটির কারণে আসামিরা খালাস পেয়েছেন ১৪টি মামলা থেকে।

১১টি মামলায় আসামিরা খালাস পাওয়ার পেছনে বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছে পিবিআই। এর মধ্যে রয়েছে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে অসংগতি, সাক্ষীকে বৈরী ঘোষণা, সাক্ষীর অনুপস্থিতি ও তদন্তের ত্রুটি। ম্যাজিস্ট্রেটের ভুলের কারণে ৪টি মামলায় খালাস পেয়েছেন আসামিরা। এ ছাড়া ১৫টি মামলায় অপরাধ প্রমাণ করা যায়নি।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে (২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল) দেশে খুন হয়েছেন ৬০ হাজার ৩৭ জন। সে হিসাবে দেশে বছরে খুন হন ৩ হাজার ৭৫২ জন।

দণ্ডবিধি অনুযায়ী খুনের মামলায় সমঝোতার সুযোগ নেই। কিন্তু খুনের অনেক ঘটনায় গোপনে সমঝোতার পর বাদী এবং সাক্ষীরা আদালতে গিয়ে মিথ্যা সাক্ষী দেন। এ ধরনের সাক্ষীকে বৈরী ঘোষণা করে রাষ্ট্রপক্ষ বিচার চলমান রাখে। কারণ, বাদী-বিবাদী সমঝোতা করলেও হত্যার বিচার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিচারক বুঝতে পারেন সাক্ষীরা মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিচারকের কিছু করার থাকে না। একপর্যায়ে আসামিদের মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে রায় দেন বিচারক।

ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার ৩০টি খুনের (২০১০-২০২৪ সাল) মামলার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গত বছরের ২৬ জুন  ‘এক উপজেলায় ১৪ বছরে ৯০ খুন, হত্যা মামলায়ও সমঝোতা হয়’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। এতে দেখা যায়, খুনের ৩০টি ঘটনার মধ্যে ১২টিতেই বাদী-বিবাদী সমঝোতা করেছিলেন। খুনের আটটি ঘটনায় করা মামলার বাদীরা প্রথম আলোকে বলেছেন, রাজনৈতিক চাপে তাঁরা সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছেন। প্রতিটি ঘটনাতেই টাকার লেনদেন হয়েছে। এর মানে হলো খুনের ঘটনাতেও সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপে অনেক ক্ষেত্রে বাদী সমঝোতা করতে বাধ্য হন।

তদন্তে ত্রুটি

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় ২০২২ সালে প্রবাসী ইউসুফ আলী হত্যার ঘটনাটি ব্যাপক আলোচিত ছিল। ২০২৪ সালে এই মামলার রায়ে ১২ আসামির সবাই খালাস পেয়েছেন। বড় ভাইয়ের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধের জেরে ছোট ভাই ইউসুফ আলীকে খুন করে প্রতিপক্ষের লোকজন।

তদন্ত কর্মকর্তার ভুলের কারণে এই মামলার আসামিরা খালাস পেয়েছেন বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের সাবেক কৌঁসুলি অশোক কুমার দাশ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আলামত জব্দ ও তদন্তের ক্ষেত্রে কিছু ত্রুটির কথা উল্লেখ করে আদালত সবাইকে খালাস দিয়েছেন। তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনাস্থলের বর্ণনা ঠিকমতো তুলে ধরতে পারেননি। এ কারণে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতেও বলেন আদালত।

খুনের বিভিন্ন মামলায় তদন্তের ত্রুটির বিষয়ে পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তদন্ত কর্মকর্তার অদক্ষতা, আন্তরিকতার অভাব এবং অতিরিক্ত কাজের চাপের পাশাপাশি তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়হীনতাও দায়ী। তদন্ত কর্মকর্তাকে কার্যকর পরামর্শ দেওয়ার জন্য একটি মনিটরিং টিম (তদারকি দল) থাকা প্রয়োজন বলে সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ ছাড়া তদন্তে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়ারও সুপারিশ করেছে পিবিআই।

ফৌজদারি অপরাধের মামলা তদন্তের জন্য পুলিশের বাইরে পৃথক সংস্থা গঠন করার প্রস্তাব করেছে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, তদন্তের জন্য গঠিত সংস্থাকে হতে হবে দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য, যাতে প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে।বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন মনে করে, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় তদন্ত একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। তদন্ত কর্মকর্তা সৎ, সাহসী, দক্ষ ও পেশাদার না হলে তদন্ত প্রতিবেদনে নানা রকম দুর্বলতা থেকে যায়।

বর্তমান ব্যবস্থায় খুনসহ বিভিন্ন ফৌজদারি অপরাধের ঘটনা তদন্ত করে পুলিশ। থানা-পুলিশের পাশাপাশি তদন্তের জন্য পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) রয়েছে। তবে এসব ইউনিট পুলিশের অধীনে পরিচালিত হয়। নিয়োগ হয় পুলিশ থেকে বদলির মাধ্যমে। কমিশনের প্রস্তাব হচ্ছে, পৃথক তদন্ত সংস্থার জনবল পুলিশ বাহিনী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হবে। তাঁদের নিয়োগ, চাকরির শর্ত, বাজেট, অবকাঠামো ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি একটি স্বতন্ত্র সংগঠন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোভুক্ত হবে। সাধারণভাবে প্রস্তাবিত সংস্থা কাজ শুরু করবে মামলা দায়েরের পর থেকেই।

বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন মনে করে, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় তদন্ত একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। তদন্ত কর্মকর্তা সৎ, সাহসী, দক্ষ ও পেশাদার না হলে তদন্ত প্রতিবেদনে নানা রকম দুর্বলতা থেকে যায়। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবসহ নানা কারণে যথাযথভাবে প্রকৃত তথ্য প্রতিফলিত হয় না।

দ্রুত ও মানসম্পন্ন তদন্তের ওপর মামলার ফলাফল অনেকাংশে নির্ভরশীল।সাজাপ্রাপ্ত মামলাগুলোর (১১৫টি) ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তদন্তে পুলিশ সময় নিয়েছে গড়ে ১ বছর ২ মাস। আর বিচারিক কার্যক্রমে সময় লেগেছে ১০ বছর ৩ মাস। অন্যদিকে খালাস পাওয়া মামলাগুলোর ক্ষেত্রে পুলিশ তদন্তে সময় নিয়েছে ১ বছর ৪ মাস এবং বিচারিক কার্যক্রমে সময় লেগেছে ১১ বছর ৬ মাস।

বিচারে দীর্ঘসূত্রতা

পিবিআইয়ের গবেষণায় মামলার বিচারের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার বিষয়টিও এসেছে। যে ২৩৮টি মামলার তথ্য পর্যালোচনা করেছে সংস্থাটি, তাতে দেখা গেছে, বিচারকাজে গড়ে প্রায় ১১ বছর সময় লেগেছে। বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে সাক্ষীদের অনুপস্থিতি বা সাক্ষ্য প্রদানে ত্রুটি হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। একইভাবে তদন্তের ক্ষেত্রেও বেশি দেরি হলে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার সঙ্গে মামলা প্রমাণিত না হওয়ার যোগসূত্র থাকে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে পিবিআই।

সাজাপ্রাপ্ত মামলাগুলোর (১১৫টি) ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তদন্তে পুলিশ সময় নিয়েছে গড়ে ১ বছর ২ মাস। আর বিচারিক কার্যক্রমে সময় লেগেছে ১০ বছর ৩ মাস। অন্যদিকে খালাস পাওয়া মামলাগুলোর ক্ষেত্রে পুলিশ তদন্তে সময় নিয়েছে ১ বছর ৪ মাস এবং বিচারিক কার্যক্রমে সময় লেগেছে ১১ বছর ৬ মাস।

পিবিআই প্রতিবেদনে বলেছে, মামলার তদন্ত ও বিচারিক কাজে বেশি সময় নেওয়া হলে সাজা হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কমে আসে।

হত্যা মামলার তদন্তে ও বিচারে দীর্ঘ সময় লাগার বিষয়টি উদ্বেগজনক বলে মনে করে পিবিআই। সংস্থাটি মনে করে, মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে বাদীপক্ষের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নানা কারণে এলাকাছাড়া হন।

আবার অনেক সাক্ষী মারাও যান। দীর্ঘ সময় হলে আসামিপক্ষ হত্যার শিকার হওয়া ব্যক্তির স্বজন ও সাক্ষীদের প্রলোভন অথবা ভয় দেখিয়ে সমঝোতায় বাধ্য করতে পারে।ফৌজদারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাষ্ট্রপক্ষের নিযুক্ত কৌঁসুলির পরামর্শ নিতে পারেন। এমনকি অভিযোগপত্র দেওয়ার আগেও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা নিতে পারেন। সমন্বয় থাকলে মামলার তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করার কাজটি সহজ হবে এবং বিচার দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তি হবে।

বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষীরা সঠিক সাক্ষ্য দেন না। এমন একটি উদাহরণ হচ্ছে চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ে এক ব্যক্তিকে পূর্বশত্রুতার জেরে খুন করা হয়। ঘটনাটি ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসের। এ ঘটনায় করা মামলার রায় হয় ২০১৬ সালে। রায়ে সব আসামিকে খালাস দেওয়া হয়। এই মামলার তদন্তে পুলিশ সময় নিয়েছে ১ বছর ২ মাস। আর বিচারে সময় লেগেছে ১৮ বছর। মূলত বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণে বাদী-বিবাদী সমঝোতা হয়ে যায়। ফলে সাক্ষীরা সঠিক সাক্ষ্য দেননি। সব আসামি খালাস পান বলে পিবিআই তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘বিশেষ প্রসিকিউটোরিয়াল উপদেষ্টা’ এহসানুল হক সমাজী প্রথম আলোকে বলেন, হত্যা মামলার আসামিদের খালাস পাওয়ার ক্ষেত্রে যেসব কারণ পিবিআই উল্লেখ করেছে, এগুলো অমূলক নয়। যেমন সাক্ষ্য–প্রমাণের অভাব, আপসমূলে সাক্ষ্য দেওয়া, সাক্ষী আদালতে না আসা, বিভিন্ন কারণে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা। মামলা প্রমাণ করার জন্য প্রাসঙ্গিক সাক্ষী কারা হবেন, সেটি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে নির্ধারণ করতে হবে। কারণ, মৌখিক ও দালিলিক সাক্ষীর মাধ্যমে অপরাধ প্রমাণ করা না গেলে আসামিরা খালাস পাবেন, এটাই স্বাভাবিক।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, ফৌজদারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাষ্ট্রপক্ষের নিযুক্ত কৌঁসুলির পরামর্শ নিতে পারেন। এমনকি অভিযোগপত্র দেওয়ার আগেও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা নিতে পারেন। সমন্বয় থাকলে মামলার তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করার কাজটি সহজ হবে এবং বিচার দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তি হবে।