ঢাকা ০৮:০৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

এতিম নেই, অনুদান চলছেই—কে খাচ্ছে এতিমের হক? প্রথম পর্ব

  • মোঃ নুরুল হুদা
  • প্রকাশের সময় : ০৯:০৭:১৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ জুন ২০২৫
  • ৬৩৮ বার পড়া হয়েছে

বিশেষ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

বিশেষ প্রতিনিধি- মোঃ নুরুল হুদা

এতিম নেই, কিন্তু লক্ষ লক্ষ টাকার অনুদান প্রত্যেক বছর উঠছে। এতিমের নামে হচ্ছে টাকা আত্মসাৎ, অথচ স্থানীয় সমাজসেবা কর্মকর্তারা মুখে কুলুপ এঁটেছেন।”
দুর্গাপুর উপজেলায় এমনই চিত্র ধরা পড়েছে অনুসন্ধানে। মোট ৭টি বেসরকারি এতিমখানা সরকার থেকে অনুদান নিচ্ছে, যার বেশিরভাগেই নেই শতকরা ২৫ ভাগ প্রকৃত এতিম নিবাসী।

নীতিমালা কী বলে, বাস্তবে কী হচ্ছে?

২০১৫ সালের ক্যাপিটেশন গ্রান্ট বরাদ্দ নীতিমালা অনুসারে:
৫০% এতিম নিবাসী না থাকলে অনুদান দেওয়া যাবে না ১০০% বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করতে হবে
খাবার ঘর, গোসলখানা, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট বাধ্যতামূলক
পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত পরিবেশন বাধ্যতামূলক
কোনোভাবেই অনুদানের টাকা অন্য খাতে ব্যবহার করা যাবে না

কিন্তু অনুসন্ধানে উঠে এলো:

হামিদা বেগম এতিমখানা—এতিম ৪-৫ জন, অথচ অনুদান ১৭.৭৬ লক্ষ
হালিমা মাপিজ এতিমখানা—অনুদান ৪.৩২ লক্ষ
আলহাজ আলাউদ্দিন এতিমখানা—৯.৮৪ লক্ষ
মানব কল্যাণ অনাতালয়—৫৬.৬৪ লক্ষ
কমর উদ্দিন মেমোরিয়াল—১৮.৭২ লক্ষ

সর্বমোট: ১ কোটি ৭২ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা (২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত)

দায়সারা কমিটি, মুখবন্ধ সভাপতি:

তথ্য সংগ্রহে গিয়ে দেখা যায়, কিছু প্রতিষ্ঠান চালায় নামমাত্র কমিটি। সভাপতিদের ফোন করলে বেশিরভাগই ফোন রিসিভ করেন না। মুহতামিমদের অনেকেই তথ্য দিতে অপারগ।

ভূয়া তালিকা বানিয়ে সরকারের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র

প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে এতিম নিবাসীর সংখ্যা দ্বিগুণ দেখিয়ে প্রতিবছর কোটি টাকার সরকারি ক্যাপিটেশন তুলে নিচ্ছে। অথচ সরকারকেই দেওয়া হচ্ছে ভুল তথ্য!

অভিযোগ ঘুষেরও:

খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী একটি প্রতিষ্ঠান—“এতেলা সেবা” দাবি করেছে, ডিজিটাল নিবন্ধনের কথা বলে সমাজসেবা অফিসের একজন সহকারী কাউসার মিয়া এক লক্ষ টাকা উৎকোচ দাবি করেন।

তবে এ বিষয়ে উপজেলা সমাজসেবা অফিসার মো. মাসুল তালুকদার এবং জেলা উপ-পরিচালক মো. শাহ আলম বলেন, তারা বিষয়টি জানেন না বা এটি ভিত্তিহীন বলে মনে করেন। যদিও তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন জেলা উপ-পরিচালক।

জনগণের প্রতিক্রিয়া:
“একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে এতিমের টাকার নামে মামলা দিয়ে জেলে রাখা হয়েছিল, অথচ এখন দিনের আলোয় এতিমের টাকায় চলছে বিলাসবহুল দুর্নীতি।”

দাবি জনগণের:
অবিলম্বে দুদক, জেলা প্রশাসন ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় যৌথভাবে তদন্ত করুক

ভূয়া এতিম দেখিয়ে যারা টাকা তুলেছে, তাদের তালিকা প্রকাশ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক

সমাজসেবা অধিদপ্তরের মধ্যে থাকা দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে

এতিমদের হক যারা মেরে খায়, তারা সমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্ট গোষ্ঠী।
সরকার যদি এখনই ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে পুরো দেশের এতিমখানাগুলো রূপ নেবে ‘অনুদান হাটে’।

এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে এখনই জেগে উঠতে হবে। না হলে আমরা হারাবো মানবতা, হারাবো নৈতিকতা

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Popular Post

মাহিন হত্যা মামলায় আরো এক আসামি গ্রেফতার হলো ফটিকছড়িতে

এতিম নেই, অনুদান চলছেই—কে খাচ্ছে এতিমের হক? প্রথম পর্ব

প্রকাশের সময় : ০৯:০৭:১৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ জুন ২০২৫

বিশেষ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

বিশেষ প্রতিনিধি- মোঃ নুরুল হুদা

এতিম নেই, কিন্তু লক্ষ লক্ষ টাকার অনুদান প্রত্যেক বছর উঠছে। এতিমের নামে হচ্ছে টাকা আত্মসাৎ, অথচ স্থানীয় সমাজসেবা কর্মকর্তারা মুখে কুলুপ এঁটেছেন।”
দুর্গাপুর উপজেলায় এমনই চিত্র ধরা পড়েছে অনুসন্ধানে। মোট ৭টি বেসরকারি এতিমখানা সরকার থেকে অনুদান নিচ্ছে, যার বেশিরভাগেই নেই শতকরা ২৫ ভাগ প্রকৃত এতিম নিবাসী।

নীতিমালা কী বলে, বাস্তবে কী হচ্ছে?

২০১৫ সালের ক্যাপিটেশন গ্রান্ট বরাদ্দ নীতিমালা অনুসারে:
৫০% এতিম নিবাসী না থাকলে অনুদান দেওয়া যাবে না ১০০% বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করতে হবে
খাবার ঘর, গোসলখানা, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট বাধ্যতামূলক
পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত পরিবেশন বাধ্যতামূলক
কোনোভাবেই অনুদানের টাকা অন্য খাতে ব্যবহার করা যাবে না

কিন্তু অনুসন্ধানে উঠে এলো:

হামিদা বেগম এতিমখানা—এতিম ৪-৫ জন, অথচ অনুদান ১৭.৭৬ লক্ষ
হালিমা মাপিজ এতিমখানা—অনুদান ৪.৩২ লক্ষ
আলহাজ আলাউদ্দিন এতিমখানা—৯.৮৪ লক্ষ
মানব কল্যাণ অনাতালয়—৫৬.৬৪ লক্ষ
কমর উদ্দিন মেমোরিয়াল—১৮.৭২ লক্ষ

সর্বমোট: ১ কোটি ৭২ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা (২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত)

দায়সারা কমিটি, মুখবন্ধ সভাপতি:

তথ্য সংগ্রহে গিয়ে দেখা যায়, কিছু প্রতিষ্ঠান চালায় নামমাত্র কমিটি। সভাপতিদের ফোন করলে বেশিরভাগই ফোন রিসিভ করেন না। মুহতামিমদের অনেকেই তথ্য দিতে অপারগ।

ভূয়া তালিকা বানিয়ে সরকারের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র

প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে এতিম নিবাসীর সংখ্যা দ্বিগুণ দেখিয়ে প্রতিবছর কোটি টাকার সরকারি ক্যাপিটেশন তুলে নিচ্ছে। অথচ সরকারকেই দেওয়া হচ্ছে ভুল তথ্য!

অভিযোগ ঘুষেরও:

খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী একটি প্রতিষ্ঠান—“এতেলা সেবা” দাবি করেছে, ডিজিটাল নিবন্ধনের কথা বলে সমাজসেবা অফিসের একজন সহকারী কাউসার মিয়া এক লক্ষ টাকা উৎকোচ দাবি করেন।

তবে এ বিষয়ে উপজেলা সমাজসেবা অফিসার মো. মাসুল তালুকদার এবং জেলা উপ-পরিচালক মো. শাহ আলম বলেন, তারা বিষয়টি জানেন না বা এটি ভিত্তিহীন বলে মনে করেন। যদিও তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন জেলা উপ-পরিচালক।

জনগণের প্রতিক্রিয়া:
“একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে এতিমের টাকার নামে মামলা দিয়ে জেলে রাখা হয়েছিল, অথচ এখন দিনের আলোয় এতিমের টাকায় চলছে বিলাসবহুল দুর্নীতি।”

দাবি জনগণের:
অবিলম্বে দুদক, জেলা প্রশাসন ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় যৌথভাবে তদন্ত করুক

ভূয়া এতিম দেখিয়ে যারা টাকা তুলেছে, তাদের তালিকা প্রকাশ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক

সমাজসেবা অধিদপ্তরের মধ্যে থাকা দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে

এতিমদের হক যারা মেরে খায়, তারা সমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্ট গোষ্ঠী।
সরকার যদি এখনই ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে পুরো দেশের এতিমখানাগুলো রূপ নেবে ‘অনুদান হাটে’।

এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে এখনই জেগে উঠতে হবে। না হলে আমরা হারাবো মানবতা, হারাবো নৈতিকতা