ঢাকা ০৭:৪৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

হারিয়ে যাচ্ছে একেকটি ভাষা, একেকটি আত্মপরিচয়

 মৌলভীবাজার একটি শিশুর প্রথম উচ্চারিত শব্দ হয় মা। সে শব্দ কোনো নির্দিষ্ট ভাষার নয়, অনুভবের। কিন্তু সেই অনুভব যদি কাগজে লেখা না যায়, পাঠে শেখা না যায়, তবে কি তা হারিয়ে যায়? মৌলভীবাজারের হাজারো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ সেই প্রশ্নের উত্তর জানে। প্রতিদিন জানে। এই জেলার আনাচে-কানাচে, পাহাড়ি টিলায়, চা-বাগানের শ্রমঘামে যে ভাষাগুলো বাস করে, সেগুলোর নাম খাসিয়া, মনিপুরি, ত্রিপুরা, ওরাঁও, তেলেগু, রবিদাস কিংবা কৈরী।

মুখে মুখে চলে আসা, পল্লিগীতির সুরে, উৎসবের মঞ্চে বেঁচে থাকা এই ভাষাগুলো এখন হারিয়ে যাওয়ার মুখে। কারণ, তাদের নেই বই, নেই পাঠশালা। “আমার মেয়েটা বাংলা লিখতে পারে, ইংরেজি বোঝে, কিন্তু আমাদের ভাষায় নিজের নামটাও লিখতে পারে না।” এ কথা বলেন লাউয়াছড়ার এক খাসিয়া মা।

ভাষা নয়, হারিয়ে যাচ্ছে আত্মপরিচয়: শিক্ষা আমাদের ভবিষ্যতের আলো। কিন্তু সেই আলোর নিচেই যদি নিজের ভাষা নিভে যায়, তাহলে সে আলো কীভাবে পথ দেখাবে? জাতীয় শিক্ষানীতিতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় পাঠদানের কথা থাকলেও মৌলভীবাজারে তা আজও বাস্তবতা হয়ে ওঠেনি। জেলার প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মাতৃভাষায় নেই কোনো পাঠ্যপুস্তক, নেই প্রশিক্ষিত শিক্ষক।

ফলে শিশুরা বাংলা শিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, আর নিজের ভাষা থেকে দূরে সরে যায়। “শিশুদের বাংলা ভাষা শেখানো হয়, কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি ও ভাষা শেখার কোনো সুযোগ নেই।” বললেন লাউয়াছড়া খাসিয়া পুঞ্জির হেডম্যান ফিলাপত্মী। চা-বাগানে শ্রম, ভাষার বেদনা: চা-বাগানের হাজারো মানুষ প্রতিদিন ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত শ্রম দেয়। তাদের মধ্যে রয়েছে তেলেগু, কৈরী, রবিদাসসহ আরও অনেক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। এই জনগোষ্ঠীগুলো দেশের অর্থনীতির এক নিরব অংশীদার।

অথচ তাদের ভাষা-সংস্কৃতির কোনো স্বীকৃতি নেই রাষ্ট্রীয় পাঠ্যক্রমে। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহ সভাপতি প্রংকজ এস কন্দ বলেন, “রাষ্ট্রের দায়িত্ব এসব ভাষা সংরক্ষণ করা। ভাষা শুধু শব্দ নয়, এটা আমাদের পরিচয়।” কমিউনিটি স্কুলের ছোট্ট চেষ্টা, বিশাল চাওয়া: মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির হেডম্যান জিডিসন সুচিয়াং জানান, “সরকারি স্কুলের অভাবে আমরা নিজেদের অর্থায়নে কমিউনিটি স্কুল চালাই। সেখানে খাসিয়া ভাষা শেখানো হয়। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এভাবে ভাষা টিকবে না।”

একই কথা বলেন মণিপুরি গবেষক ফাল্গুনী সিংহ। “সরকারি উদ্যোগ ছাড়া এসব ভাষা হারিয়ে যাবে। স্কুল নেই, ভাষাকেন্দ্র নেই, নেই সচেতনতা।” সাংস্কৃতিক কর্মী সাজু মার্চিয়াং জানান, “শুধু খাসিয়াদের মধ্যেই প্রায় ৩০ হাজার মানুষ মৌলভীবাজারে বাস করে। আজ তাদের অধিকাংশই বাংলা ভাষায় কথা বলে। নিজেদের ভাষা তারা ভুলে যেতে বসেছে।” সরকারি আশ্বাস—আলো আছে কি সামনে: মৌলভীবাজার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শফিউল আলম বলেন, এ জেলায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় পাঠদানের প্রক্রিয়া চালু হয়নি।

এ বিষয়ে কোন আলাদা শিক্ষকও নেই আমাদের। তাই বলে একটি ভাষাকে আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। আমরা আন্তরিক। তবে স্থানীয়রা বলছেন, আশ্বাসে নয়, বাস্তবায়নে প্রয়োজন রাষ্ট্রের আন্তরিকতা। শুধু দুই-একটি উপজেলায় নয়, সমগ্র মৌলভীবাজার ও বৃহত্তর সিলেটে সমানভাবে প্রয়োজন নীতিগত সিদ্ধান্ত ও বরাদ্দ। ভাষা হারালে মানুষও হারায়: ভাষা কেবল ভাব প্রকাশের মাধ্যম নয়।

এটা ইতিহাস, সংস্কৃতি, অনুভবের প্রকাশ। একেকটি ভাষার মৃত্যু মানে একেকটি জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের বিলুপ্তি। যেসব শিশু আজ নিজেদের ভাষায় লিখতে পারে না, তারা একদিন নিজেদের শিকড় ভুলে যাবে। মৌলভীবাজারের পাহাড়ে, চা-বাগানে, বনপথে হারিয়ে যাবে শতাব্দী প্রাচীন শব্দেরা। মৌলভীবাজার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টীর সমন্বয়ক তাজুল ইসলাম জাবেদ, এখানে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টীর মৌলিক দাবি হচ্ছে শিক্ষা সংস্কৃতি ও ভুমি অধিকার। আর তাই সময় এসেছে জোর দিয়ে বলার, মাতৃভাষা বাঁচাও, জাতিসত্তা বাঁচাও। নইলে কিছু বছর পর হয়তো এই ভাষাগুলোর আর কোনো উচ্চারণই শোনা যাবে না।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Gojnobi biplob

Popular Post

মাহিন হত্যা মামলায় আরো এক আসামি গ্রেফতার হলো ফটিকছড়িতে

হারিয়ে যাচ্ছে একেকটি ভাষা, একেকটি আত্মপরিচয়

প্রকাশের সময় : ০৫:৩৪:৫০ অপরাহ্ন, শনিবার, ৯ অগাস্ট ২০২৫

 মৌলভীবাজার একটি শিশুর প্রথম উচ্চারিত শব্দ হয় মা। সে শব্দ কোনো নির্দিষ্ট ভাষার নয়, অনুভবের। কিন্তু সেই অনুভব যদি কাগজে লেখা না যায়, পাঠে শেখা না যায়, তবে কি তা হারিয়ে যায়? মৌলভীবাজারের হাজারো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ সেই প্রশ্নের উত্তর জানে। প্রতিদিন জানে। এই জেলার আনাচে-কানাচে, পাহাড়ি টিলায়, চা-বাগানের শ্রমঘামে যে ভাষাগুলো বাস করে, সেগুলোর নাম খাসিয়া, মনিপুরি, ত্রিপুরা, ওরাঁও, তেলেগু, রবিদাস কিংবা কৈরী।

মুখে মুখে চলে আসা, পল্লিগীতির সুরে, উৎসবের মঞ্চে বেঁচে থাকা এই ভাষাগুলো এখন হারিয়ে যাওয়ার মুখে। কারণ, তাদের নেই বই, নেই পাঠশালা। “আমার মেয়েটা বাংলা লিখতে পারে, ইংরেজি বোঝে, কিন্তু আমাদের ভাষায় নিজের নামটাও লিখতে পারে না।” এ কথা বলেন লাউয়াছড়ার এক খাসিয়া মা।

ভাষা নয়, হারিয়ে যাচ্ছে আত্মপরিচয়: শিক্ষা আমাদের ভবিষ্যতের আলো। কিন্তু সেই আলোর নিচেই যদি নিজের ভাষা নিভে যায়, তাহলে সে আলো কীভাবে পথ দেখাবে? জাতীয় শিক্ষানীতিতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় পাঠদানের কথা থাকলেও মৌলভীবাজারে তা আজও বাস্তবতা হয়ে ওঠেনি। জেলার প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মাতৃভাষায় নেই কোনো পাঠ্যপুস্তক, নেই প্রশিক্ষিত শিক্ষক।

ফলে শিশুরা বাংলা শিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, আর নিজের ভাষা থেকে দূরে সরে যায়। “শিশুদের বাংলা ভাষা শেখানো হয়, কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি ও ভাষা শেখার কোনো সুযোগ নেই।” বললেন লাউয়াছড়া খাসিয়া পুঞ্জির হেডম্যান ফিলাপত্মী। চা-বাগানে শ্রম, ভাষার বেদনা: চা-বাগানের হাজারো মানুষ প্রতিদিন ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত শ্রম দেয়। তাদের মধ্যে রয়েছে তেলেগু, কৈরী, রবিদাসসহ আরও অনেক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। এই জনগোষ্ঠীগুলো দেশের অর্থনীতির এক নিরব অংশীদার।

অথচ তাদের ভাষা-সংস্কৃতির কোনো স্বীকৃতি নেই রাষ্ট্রীয় পাঠ্যক্রমে। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহ সভাপতি প্রংকজ এস কন্দ বলেন, “রাষ্ট্রের দায়িত্ব এসব ভাষা সংরক্ষণ করা। ভাষা শুধু শব্দ নয়, এটা আমাদের পরিচয়।” কমিউনিটি স্কুলের ছোট্ট চেষ্টা, বিশাল চাওয়া: মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির হেডম্যান জিডিসন সুচিয়াং জানান, “সরকারি স্কুলের অভাবে আমরা নিজেদের অর্থায়নে কমিউনিটি স্কুল চালাই। সেখানে খাসিয়া ভাষা শেখানো হয়। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এভাবে ভাষা টিকবে না।”

একই কথা বলেন মণিপুরি গবেষক ফাল্গুনী সিংহ। “সরকারি উদ্যোগ ছাড়া এসব ভাষা হারিয়ে যাবে। স্কুল নেই, ভাষাকেন্দ্র নেই, নেই সচেতনতা।” সাংস্কৃতিক কর্মী সাজু মার্চিয়াং জানান, “শুধু খাসিয়াদের মধ্যেই প্রায় ৩০ হাজার মানুষ মৌলভীবাজারে বাস করে। আজ তাদের অধিকাংশই বাংলা ভাষায় কথা বলে। নিজেদের ভাষা তারা ভুলে যেতে বসেছে।” সরকারি আশ্বাস—আলো আছে কি সামনে: মৌলভীবাজার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শফিউল আলম বলেন, এ জেলায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় পাঠদানের প্রক্রিয়া চালু হয়নি।

এ বিষয়ে কোন আলাদা শিক্ষকও নেই আমাদের। তাই বলে একটি ভাষাকে আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। আমরা আন্তরিক। তবে স্থানীয়রা বলছেন, আশ্বাসে নয়, বাস্তবায়নে প্রয়োজন রাষ্ট্রের আন্তরিকতা। শুধু দুই-একটি উপজেলায় নয়, সমগ্র মৌলভীবাজার ও বৃহত্তর সিলেটে সমানভাবে প্রয়োজন নীতিগত সিদ্ধান্ত ও বরাদ্দ। ভাষা হারালে মানুষও হারায়: ভাষা কেবল ভাব প্রকাশের মাধ্যম নয়।

এটা ইতিহাস, সংস্কৃতি, অনুভবের প্রকাশ। একেকটি ভাষার মৃত্যু মানে একেকটি জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের বিলুপ্তি। যেসব শিশু আজ নিজেদের ভাষায় লিখতে পারে না, তারা একদিন নিজেদের শিকড় ভুলে যাবে। মৌলভীবাজারের পাহাড়ে, চা-বাগানে, বনপথে হারিয়ে যাবে শতাব্দী প্রাচীন শব্দেরা। মৌলভীবাজার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টীর সমন্বয়ক তাজুল ইসলাম জাবেদ, এখানে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টীর মৌলিক দাবি হচ্ছে শিক্ষা সংস্কৃতি ও ভুমি অধিকার। আর তাই সময় এসেছে জোর দিয়ে বলার, মাতৃভাষা বাঁচাও, জাতিসত্তা বাঁচাও। নইলে কিছু বছর পর হয়তো এই ভাষাগুলোর আর কোনো উচ্চারণই শোনা যাবে না।