
নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার গন্ডা ইউনিয়নের বড় কাইল্যাইন গ্রামে প্রেমিক সেনা সদস্যকে আটক করে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগে তোলপাড় এলাকা।
ঘটনাটি ঘিরে এলাকায় যেমন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি উঠেছে নৈতিকতা, নারী অধিকার এবং আইনের শাসন নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন। জানা যায়, গত ৬ জুলাই রোববার রাত ৮টার দিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য মাহমুদুল হাসান লিংকন (২৬) তার প্রেমিকা রুমার সঙ্গে দেখা করতে যান। তিনি ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার চণ্ডিপাশা ইউনিয়নের ধড়ুয়া গ্রামের হেলাল উদ্দিন ভূঁইয়ার ছেলে এবং বর্তমানে চট্টগ্রামের ইবিআরসি (EBRC)-তে কর্মরত।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আঠারবাড়ি কলেজে পড়ার সময় থেকেই লিংকন ও রুমার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং বিগত তিন বছর ধরে তা চলমান ছিল। ছুটিতে বাড়ি এসে প্রেমিকার বাড়িতে দেখা করতে যান লিংকন। রাতের বেলা ঘরে অবস্থানকালে স্থানীয় কিছু ব্যক্তি তাদের আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলে এবং সেনা সদস্য লিংকনকে আটক করে। এ সময় স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি—যাদের মধ্যে বিএনপির ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাসহ কিছু মাতব্বরও ছিলেন—‘সামাজিক সমাধান’-এর নামে তাকে অন্য একটি বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। অভিযোগ রয়েছে, লিখিতভাবে দুই লাখ টাকা এবং মৌখিকভাবে আরও এক লাখ টাকার বিনিময়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
অর্থাৎ, সেনা সদস্যকে মুক্তি দিতে তিন লাখ টাকার লেনদেন হয়। ঘটনার পরপরই প্রেমিকা রুমা গণমাধ্যমকে জানান, তাকে সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে টাকার লেনদেনের মাধ্যমে যেন পণ্যের মতো কেনাবেচা করা হয়েছে। তিনি বলেন, “আমাকে সামাজিকভাবে হেয় করে কেউ টাকা খেয়েছে। আমি এর বিচার চাই। আমি লিংকনের সঙ্গে বৈধভাবে সংসার করতে চাই। বিয়ের দাবি নিয়ে আমি তার বাড়িতে গিয়েছি। যতক্ষণ না বিয়ে হয়, ততক্ষণ আমি সেখানেই থাকবো।” তিনি আরও অভিযোগ করেন, প্রেমিক লিংকন তাকে দীর্ঘদিন ধরে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছেন।
ঘটনাস্থলে ধরা পড়ার সময়ও তিনি বিয়ের কথা স্বীকার করেছিলেন। তা সত্ত্বেও প্রভাবশালীরা রুমার মতামত না নিয়েই মীমাংসা করেন এবং তাকে বাইরে রেখেই ছেলেকে ছেড়ে দেন। রুমা গণমাধ্যমকে আরও জানান, স্থানীয় বিএনপি নেতাসহ প্রভাবশালী কয়েকজন ব্যক্তি—আজিজুল, আনু মিয়া, নুর মিয়া, কামাল, জব্বার ও সোহাগ মিয়া—তাকে না জানিয়ে নগদ অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে মীমাংসা করেছেন। এতে তিনি চরমভাবে অপমানিত, লাঞ্ছিত এবং ক্ষুব্ধ।
তিনি প্রশাসনের কাছে সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। প্রভাবশালী আজিজুল ও নুর মিয়া বিষয়টি অস্বীকার করে জানান, তারা ঘটনাটি সম্পর্কে অবগত নন। তবে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছে, তাদের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততায় অর্থ লেনদেন ও আপোষের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। সচেতন মহলের মতে, এ ধরনের গ্রাম্য সালিশ আইনের চোখে অপরাধ ও চাঁদাবাজির শামিল। একজন সেনা সদস্যকে আটক করে অর্থ আদায় এবং একজন নারীকে লেনদেনের কেন্দ্রবিন্দু বানানো সংবিধান ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
এ বিষয়ে কেন্দুয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মিজানুর রহমান মুঠোফোনে বলেন, “আমরা এখনো এ বিষয়ে কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” এই ঘটনাটি নিছক একটি প্রেমঘটিত ইস্যু নয়, বরং সমাজে নারীর সম্মান, আইনের শাসন এবং ক্ষমতাবানদের দৌরাত্ম্য নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় এনে দিয়েছে।
এলাকাবাসী ও মানবাধিকারকর্মীরা দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন, যেন ভবিষ্যতে কেউ এমন বেআইনি ও ন্যক্কারজনক ঘটনার সাহস না পায়।