ঢাকা ১২:১০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দুদিন ধরে দেখা মিলছে না খামেনির , এ অবস্থায় চরম উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে সাধারণ ইরানিদের মধ্যে

  • প্রতিবেদক এর নাম
  • প্রকাশের সময় : ০৪:৪৩:৫৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
  • ২৫১ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

তীব্র সংঘাতময় ১২ দিন শেষে আপাতত যুদ্ধবিরতি চলছে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে। গত দুইদিনে কোনও হামলার খবরও পাওয়া যাচ্ছে না কোনও দিক থেকে। কিন্তু যুদ্ধ পরিস্থিতিতে প্রাণনাশের আশঙ্কায় গোপন আশ্রয়ে চলে যাওয়া ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির দেখা মেলেনি এখন পর্যন্ত। এমনকি কোনও বার্তাও আসেনি তার পক্ষ থেকে। এদিকে তার অনুপস্থিতিতে ইরানে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছে নতুন নতুন জোট, ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন যারা।

বিজ্ঞাপন

এ অবস্থায় চরম উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে সাধারণ ইরানিদের মধ্যে। সবার মনে একটাই প্রশ্ন খামেনি আসলে কোথায়; কী হাল তার?

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের একজন উপস্থাপক তো সরাসরি প্রশ্নই তুলে দিয়েছেন এ নিয়ে। গত মঙ্গলবার আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির দপ্তরের এক কর্মকর্তা মেহদি ফাজায়েলিকে ওই উপস্থাপক বলেন, ‘দুই সপ্তাহ ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে খামেনি। দেশের সর্বোচ্চ নেতাকে নিয়ে খুব চিন্তিত মানুষ। তার কী অবস্থা, বলতে পারেন?’

বিজ্ঞাপন

তবে, এ প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর দেননি ফাজায়েলি। উল্টো বলেন, ‘আমরাও অনেক জায়গা থেকে এমন উদ্বেগের খবর পাচ্ছি। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ভয়াবহ বোমা হামলার পর আয়াতুল্লাহর নিরাপত্তা নিয়ে বহু মানুষ উদ্বিগ্ন। আমাদের সবাইকে তাঁর জন্য দোয়া করতে হবে।’

খামেনির আর্কাইভ দপ্তরের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সর্বোচ্চ নেতাকে রক্ষা করা যাদের দায়িত্ব, তারা তাদের কাজ ভালোভাবেই করছেন। আল্লাহ চাইলে, আমাদের জনগণ তাদের নেতাকে সঙ্গে নিয়েই বিজয় উদ্‌যাপন করতে পারবেন।’

সংঘাত চলাকালীন সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছিল, এক সুরক্ষিত বাঙ্কারে আছেন খামেনি। তার প্রাণনাশের জন্য ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো সময় গোপন অভিযান চালাতে পারে, এমন আশঙ্কায় সব ধরনের ইলেকট্রনিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলছেন তিনি।দেশের সর্বোচ্চ নেতার এমন দীর্ঘ অনুপস্থিতি শুধু জনসাধারণ নয়, ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি করেছে রাজনৈতিক মহলেও।

বিজ্ঞাপন

‘খানমান’ নামের একটি দৈনিক পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মোহসেন খালিফেহ বলেন, ‘খামেনির কয়েক দিনের এ অনুপস্থিতি আমাদের, যারা তাকে ভালোবাসি, গভীর উদ্বেগে ফেলেছে।’

দুই সপ্তাহ আগেও যে আশঙ্কা অকল্পনীয় ছিল, তা এখন স্বীকার করে এ সম্পাদক বলেন, ‘যদি তিনি (খামেনি) মারা যান, তার জানাজার মিছিল হবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও গৌরবময়।’

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে প্রতিটি বড় সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত অনুমোদন দেন খামেনি। সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পদক্ষেপ, যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে হামলা বা ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির মতো সিদ্ধান্তে তাঁর অনুমোদন অত্যাবশ্যক। যাই হোক, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আহ্বানে এবং কাতারের আমিরের মধ্যস্থতায় দ্রুত সম্পাদিত হয়। তবে ইরানের ঊর্ধ্বতন সামরিক ও সরকারি কর্মকর্তারা গত কয়েক দিনে খামেনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন কি না বা কোনোভাবে যোগাযোগ হয়েছে কি না, সে বিষয়ে খোলাখুলি কিছু বলেননি।

এই নীরবতাই জন্ম দিচ্ছে নানা প্রশ্ন ও জল্পনার—সাম্প্রতিক বড় সিদ্ধান্তগুলোতে খামেনির ভূমিকা কতটুকু? তার কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে কি? তিনি এখনো দেশ পরিচালনায় সক্রিয়? তিনি অসুস্থ না আহত কিংবা আদৌ বেঁচে আছেন কি?

রাজনৈতিক বিশ্লেষক হামজা সাফাভি আয়াতুল্লাহ খামেনির শীর্ষ সামরিক উপদেষ্টা ও রেভল্যুশনারি গার্ডস কোরের জেনারেল ইয়াহিয়া সাফাভির ছেলে। হামজার ভাষ্য, ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী বিশ্বাস করে, যুদ্ধবিরতির মধ্যেও ইসরায়েল খামেনিকে হত্যাচেষ্টা চালাতে পারে। তাই তার নিরাপত্তায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে তার যোগাযোগ প্রায় বন্ধ রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘দেশকে এ সংকট থেকে উত্তরণে এখন বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের মতো নেতাদের ক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে।’তবে হামজা সাফাভির ধারণা, খামেনি এখনো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দূর থেকে অনুমোদন দিচ্ছেন।

তবুও খামেনির অনেক সমর্থক এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলছেন, সর্বোচ্চ নেতাকে না দেখা বা তার কথা না শোনা পর্যন্ত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিজয়ের আনন্দ অনুভব করতে পারছেন না তারা।এদিকে ইরান সরকারের নীতিনির্ধারণে যুক্ত অন্তত চারজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, খামেনির অনুপস্থিতিতে রাজনীতিক ও সামরিক নেতারা নতুন নতুন জোট গঠন করছেন এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের মধ্যস্থতা কিংবা ইসরায়েলের ব্যাপারে অবস্থান নিয়ে ভিন্নমতও পোষণ করছেন।

এ মুহূর্তে দৃশ্যত যে গোষ্ঠী অপেক্ষাকৃত প্রভাবশালী, তারা সংযম ও কূটনৈতিক পথ গ্রহণের পক্ষে। এ গোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান। তিনি এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আবার আলোচনায় ফেরার ইঙ্গিতও দিয়েছেন। তার মিত্রদের মধ্যে আছেন আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠজন ও বিচার বিভাগের প্রধান গোলাম হোসেইন মোহসেনি-এজেই ও সশস্ত্র বাহিনীর নতুন প্রধান মেজর জেনারেল আবদুর রহিম মুসাভি।

গতকাল বুধবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান বলেন, ‘এই যুদ্ধ এবং জনগণের ঐক্য আমাদের শাসনব্যবস্থা ও সরকারের আচরণে নতুন চিন্তার সুযোগ এনে দিয়েছে। এটা পরিবর্তনের এক সোনালি সুযোগ।’

ইরানকে আরও সমৃদ্ধ ও সামাজিকভাবে উদার করা এবং পশ্চিমাদের সঙ্গে আরও বেশি যোগাযোগ স্থাপন করে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গত বছর ক্ষমতায় আসেন পেজেশকিয়ান।সরকার এখন জাতীয়তাবাদী আবেগ কাজে লাগাতে চাইছে। এটি জন্ম নিয়েছে ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলার পর। ইরানি কর্মকর্তারা বলছেন, হামলায় ছয় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। ওই আবেগ কাজে লাগানোর অংশ হিসেবে মঙ্গলবার রাজধানী তেহরানের আজাদি স্কয়ারে (স্বাধীনতার প্রতীকী স্থাপনা) এক উন্মুক্ত কনসার্ট আয়োজন করা হয়। এরপর আলোক প্রদর্শনীতে জরুরি সেবা বিভাগের কর্মীদের ছবি তুলে ধরা হয় স্কয়ারের স্মৃতিসৌধে।

তবে, ভিন্নমতাবলম্বী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতাও চলছে বলে জানান কর্মকর্তারা। কট্টরপন্থী রাজনীতিক সাঈদ জলিলির নেতৃত্বে থাকা একটি রক্ষণশীল গোষ্ঠী প্রকাশ্যে প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সমালোচনা করেছে। ‘বিস্ময়কর’ যুদ্ধবিরতি ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আবারও পারমাণবিক আলোচনা শুরুর ইঙ্গিতে নিন্দা জানিয়েছে তারা।এই গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছেন পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ রক্ষণশীল এমপিরা ও রেভল্যুশনারি গার্ডের কিছু জ্যেষ্ঠ কমান্ডার।

সাঈদ জলিলি ও রেভল্যুশনারি গার্ডসের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফুয়াদ ইজাদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে বলেন, পেজেশকিয়ানের আলোচনার বার্তা এখন মনে করিয়ে দিচ্ছে, ‘ইরানের প্রেসিডেন্টের দেশ পরিচালনার প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক দক্ষতা নেই।’

এতে পাল্টা জবাব দেন প্রেসিডেন্টের প্রধান যোগাযোগ কর্মকর্তা আলী আহমাদনিয়া। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, ‘আমরা ১২ দিন ধরে দিনরাত ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করছি। এখন কি তোমাদের সঙ্গেও লড়তে হবে, তোমরা যারা কলম দিয়ে শত্রুর খেলায় ঘুঁটি সাজাচ্ছো?’

খামেনি অনুপস্থিতিতে প্রশ্ন উঠে গেছে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ভবিষ্যৎ নিয়েও। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি ও পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ এসলামি অবশ্য স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে জানান, ইরান পারমাণবিক স্থাপনা পুনর্গঠন ও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম চালিয়ে যাবে।

যুক্তরাজ্যের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাবিষয়ক পরিচালক সানাম ভাকিল বলেন, ‘খামেনির অনুপস্থিতি উল্লেখযোগ্য এক ঘটনা এবং এটি এই ইঙ্গিত দেয়, ইরানি নেতৃত্ব এখন অতিমাত্রায় সতর্ক ও নিরাপত্তাকেন্দ্রিক ভাবনায় চলছে। আসছে আশুরার (১০ মহররম) আগে যদি খামেনিকে দেখা না যায়, তাহলে তা হবে খারাপ সংকেত। তাকে অবশ্যই জনসমক্ষে আসতে হবে।’

 

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Gojnobi biplob

Popular Post

মাহিন হত্যা মামলায় আরো এক আসামি গ্রেফতার হলো ফটিকছড়িতে

দুদিন ধরে দেখা মিলছে না খামেনির , এ অবস্থায় চরম উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে সাধারণ ইরানিদের মধ্যে

প্রকাশের সময় : ০৪:৪৩:৫৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫

ছবি সংগৃহীত

তীব্র সংঘাতময় ১২ দিন শেষে আপাতত যুদ্ধবিরতি চলছে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে। গত দুইদিনে কোনও হামলার খবরও পাওয়া যাচ্ছে না কোনও দিক থেকে। কিন্তু যুদ্ধ পরিস্থিতিতে প্রাণনাশের আশঙ্কায় গোপন আশ্রয়ে চলে যাওয়া ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির দেখা মেলেনি এখন পর্যন্ত। এমনকি কোনও বার্তাও আসেনি তার পক্ষ থেকে। এদিকে তার অনুপস্থিতিতে ইরানে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছে নতুন নতুন জোট, ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন যারা।

বিজ্ঞাপন

এ অবস্থায় চরম উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে সাধারণ ইরানিদের মধ্যে। সবার মনে একটাই প্রশ্ন খামেনি আসলে কোথায়; কী হাল তার?

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের একজন উপস্থাপক তো সরাসরি প্রশ্নই তুলে দিয়েছেন এ নিয়ে। গত মঙ্গলবার আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির দপ্তরের এক কর্মকর্তা মেহদি ফাজায়েলিকে ওই উপস্থাপক বলেন, ‘দুই সপ্তাহ ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে খামেনি। দেশের সর্বোচ্চ নেতাকে নিয়ে খুব চিন্তিত মানুষ। তার কী অবস্থা, বলতে পারেন?’

বিজ্ঞাপন

তবে, এ প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর দেননি ফাজায়েলি। উল্টো বলেন, ‘আমরাও অনেক জায়গা থেকে এমন উদ্বেগের খবর পাচ্ছি। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ভয়াবহ বোমা হামলার পর আয়াতুল্লাহর নিরাপত্তা নিয়ে বহু মানুষ উদ্বিগ্ন। আমাদের সবাইকে তাঁর জন্য দোয়া করতে হবে।’

খামেনির আর্কাইভ দপ্তরের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সর্বোচ্চ নেতাকে রক্ষা করা যাদের দায়িত্ব, তারা তাদের কাজ ভালোভাবেই করছেন। আল্লাহ চাইলে, আমাদের জনগণ তাদের নেতাকে সঙ্গে নিয়েই বিজয় উদ্‌যাপন করতে পারবেন।’

সংঘাত চলাকালীন সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছিল, এক সুরক্ষিত বাঙ্কারে আছেন খামেনি। তার প্রাণনাশের জন্য ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো সময় গোপন অভিযান চালাতে পারে, এমন আশঙ্কায় সব ধরনের ইলেকট্রনিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলছেন তিনি।দেশের সর্বোচ্চ নেতার এমন দীর্ঘ অনুপস্থিতি শুধু জনসাধারণ নয়, ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি করেছে রাজনৈতিক মহলেও।

বিজ্ঞাপন

‘খানমান’ নামের একটি দৈনিক পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মোহসেন খালিফেহ বলেন, ‘খামেনির কয়েক দিনের এ অনুপস্থিতি আমাদের, যারা তাকে ভালোবাসি, গভীর উদ্বেগে ফেলেছে।’

দুই সপ্তাহ আগেও যে আশঙ্কা অকল্পনীয় ছিল, তা এখন স্বীকার করে এ সম্পাদক বলেন, ‘যদি তিনি (খামেনি) মারা যান, তার জানাজার মিছিল হবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও গৌরবময়।’

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে প্রতিটি বড় সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত অনুমোদন দেন খামেনি। সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পদক্ষেপ, যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে হামলা বা ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির মতো সিদ্ধান্তে তাঁর অনুমোদন অত্যাবশ্যক। যাই হোক, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আহ্বানে এবং কাতারের আমিরের মধ্যস্থতায় দ্রুত সম্পাদিত হয়। তবে ইরানের ঊর্ধ্বতন সামরিক ও সরকারি কর্মকর্তারা গত কয়েক দিনে খামেনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন কি না বা কোনোভাবে যোগাযোগ হয়েছে কি না, সে বিষয়ে খোলাখুলি কিছু বলেননি।

এই নীরবতাই জন্ম দিচ্ছে নানা প্রশ্ন ও জল্পনার—সাম্প্রতিক বড় সিদ্ধান্তগুলোতে খামেনির ভূমিকা কতটুকু? তার কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে কি? তিনি এখনো দেশ পরিচালনায় সক্রিয়? তিনি অসুস্থ না আহত কিংবা আদৌ বেঁচে আছেন কি?

রাজনৈতিক বিশ্লেষক হামজা সাফাভি আয়াতুল্লাহ খামেনির শীর্ষ সামরিক উপদেষ্টা ও রেভল্যুশনারি গার্ডস কোরের জেনারেল ইয়াহিয়া সাফাভির ছেলে। হামজার ভাষ্য, ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী বিশ্বাস করে, যুদ্ধবিরতির মধ্যেও ইসরায়েল খামেনিকে হত্যাচেষ্টা চালাতে পারে। তাই তার নিরাপত্তায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে তার যোগাযোগ প্রায় বন্ধ রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘দেশকে এ সংকট থেকে উত্তরণে এখন বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের মতো নেতাদের ক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে।’তবে হামজা সাফাভির ধারণা, খামেনি এখনো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দূর থেকে অনুমোদন দিচ্ছেন।

তবুও খামেনির অনেক সমর্থক এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলছেন, সর্বোচ্চ নেতাকে না দেখা বা তার কথা না শোনা পর্যন্ত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিজয়ের আনন্দ অনুভব করতে পারছেন না তারা।এদিকে ইরান সরকারের নীতিনির্ধারণে যুক্ত অন্তত চারজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, খামেনির অনুপস্থিতিতে রাজনীতিক ও সামরিক নেতারা নতুন নতুন জোট গঠন করছেন এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের মধ্যস্থতা কিংবা ইসরায়েলের ব্যাপারে অবস্থান নিয়ে ভিন্নমতও পোষণ করছেন।

এ মুহূর্তে দৃশ্যত যে গোষ্ঠী অপেক্ষাকৃত প্রভাবশালী, তারা সংযম ও কূটনৈতিক পথ গ্রহণের পক্ষে। এ গোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান। তিনি এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আবার আলোচনায় ফেরার ইঙ্গিতও দিয়েছেন। তার মিত্রদের মধ্যে আছেন আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠজন ও বিচার বিভাগের প্রধান গোলাম হোসেইন মোহসেনি-এজেই ও সশস্ত্র বাহিনীর নতুন প্রধান মেজর জেনারেল আবদুর রহিম মুসাভি।

গতকাল বুধবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান বলেন, ‘এই যুদ্ধ এবং জনগণের ঐক্য আমাদের শাসনব্যবস্থা ও সরকারের আচরণে নতুন চিন্তার সুযোগ এনে দিয়েছে। এটা পরিবর্তনের এক সোনালি সুযোগ।’

ইরানকে আরও সমৃদ্ধ ও সামাজিকভাবে উদার করা এবং পশ্চিমাদের সঙ্গে আরও বেশি যোগাযোগ স্থাপন করে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গত বছর ক্ষমতায় আসেন পেজেশকিয়ান।সরকার এখন জাতীয়তাবাদী আবেগ কাজে লাগাতে চাইছে। এটি জন্ম নিয়েছে ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলার পর। ইরানি কর্মকর্তারা বলছেন, হামলায় ছয় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। ওই আবেগ কাজে লাগানোর অংশ হিসেবে মঙ্গলবার রাজধানী তেহরানের আজাদি স্কয়ারে (স্বাধীনতার প্রতীকী স্থাপনা) এক উন্মুক্ত কনসার্ট আয়োজন করা হয়। এরপর আলোক প্রদর্শনীতে জরুরি সেবা বিভাগের কর্মীদের ছবি তুলে ধরা হয় স্কয়ারের স্মৃতিসৌধে।

তবে, ভিন্নমতাবলম্বী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতাও চলছে বলে জানান কর্মকর্তারা। কট্টরপন্থী রাজনীতিক সাঈদ জলিলির নেতৃত্বে থাকা একটি রক্ষণশীল গোষ্ঠী প্রকাশ্যে প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সমালোচনা করেছে। ‘বিস্ময়কর’ যুদ্ধবিরতি ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আবারও পারমাণবিক আলোচনা শুরুর ইঙ্গিতে নিন্দা জানিয়েছে তারা।এই গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছেন পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ রক্ষণশীল এমপিরা ও রেভল্যুশনারি গার্ডের কিছু জ্যেষ্ঠ কমান্ডার।

সাঈদ জলিলি ও রেভল্যুশনারি গার্ডসের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফুয়াদ ইজাদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে বলেন, পেজেশকিয়ানের আলোচনার বার্তা এখন মনে করিয়ে দিচ্ছে, ‘ইরানের প্রেসিডেন্টের দেশ পরিচালনার প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক দক্ষতা নেই।’

এতে পাল্টা জবাব দেন প্রেসিডেন্টের প্রধান যোগাযোগ কর্মকর্তা আলী আহমাদনিয়া। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, ‘আমরা ১২ দিন ধরে দিনরাত ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করছি। এখন কি তোমাদের সঙ্গেও লড়তে হবে, তোমরা যারা কলম দিয়ে শত্রুর খেলায় ঘুঁটি সাজাচ্ছো?’

খামেনি অনুপস্থিতিতে প্রশ্ন উঠে গেছে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ভবিষ্যৎ নিয়েও। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি ও পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ এসলামি অবশ্য স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে জানান, ইরান পারমাণবিক স্থাপনা পুনর্গঠন ও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম চালিয়ে যাবে।

যুক্তরাজ্যের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাবিষয়ক পরিচালক সানাম ভাকিল বলেন, ‘খামেনির অনুপস্থিতি উল্লেখযোগ্য এক ঘটনা এবং এটি এই ইঙ্গিত দেয়, ইরানি নেতৃত্ব এখন অতিমাত্রায় সতর্ক ও নিরাপত্তাকেন্দ্রিক ভাবনায় চলছে। আসছে আশুরার (১০ মহররম) আগে যদি খামেনিকে দেখা না যায়, তাহলে তা হবে খারাপ সংকেত। তাকে অবশ্যই জনসমক্ষে আসতে হবে।’