
ছবি সংগৃহিত
ঢাকার সাতটি বড় সরকারি কলেজ একীভূত করে সরকার যে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করতে যাচ্ছে, তার কাঠামো নিয়ে এবার তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন ঢাকা কলেজের প্রাক্তন ছাত্ররা। তাঁরা বলছেন, প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন এবং শত বছরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ‘হাইব্রিড কাঠামো’ বা কোনো অপ্রচলিত শিক্ষাকাঠামোর পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপকরণে পরিণত করা যাবে না। যেকোনো মূল্যে দেশের প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ ঢাকা কলেজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ করতে হবে।
এ নিয়ে ঢাকা কলেজের প্রাক্তন ছাত্ররা সরকারের কাছে ১০ দফা দাবি তুলে ধরেছে বলেছেন, এ বিষয়ে সরকারকে চার দিন সময় দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে আগামী বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করা হবে। এরপরও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়া হলে বৃহত্তর আন্দোলন করার হুমকি দিয়েছেন তাঁরা।
২০১৭ সালে যথেষ্ট প্রস্তুতি ছাড়াই ঢাকার বড় সাতটি সরকারি কলেজকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছিল। তখন থেকেই সংকট ছিল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে সাত কলেজকে আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা করার ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চূড়ান্ত করার আগেই অধিভুক্তি বাতিল করায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। এখন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষকে প্রশাসক করে অন্তর্বর্তীব্যবস্থায় সাত কলেজের কার্যক্রম চলছে।সরকারি এসব কলেজ হলো—ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বাঙলা কলেজ ও তিতুমীর কলেজ। এখন এসব কলেজ একীভূত করে সরকার নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় করতে যাচ্ছে।
প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’। সাতটি কলেজ হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠকেন্দ্র (একাডেমিক ক্যাম্পাস)। একেক ক্যাম্পাসে আলাদা আলাদা বিষয়ে (ডিসিপ্লিন) পড়ানো হবে। বিষয়ও কমে যাবে। প্রস্তাবিত এই কাঠামো নিয়ে ওই সব কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিয়েছেন। এ নিয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা আন্দোলনে নেমেছেন।
আজকের সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে ১৮৫ বছরের পুরোনো ঢাকা কলেজের ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরে বলা হয়, প্রস্তাবিত ‘ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়ের’ খসড়া অধ্যাদেশ অংশীজন সবাইকে হতাশ করেছে। সংকীর্ণ স্বার্থে প্রণীত এই অবিবেচনাপ্রসূত খসড়া অধ্যাদেশ সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মতো প্রাক্তন শিক্ষার্থীদেরও আহত ও ক্ষুব্ধ করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে ১০ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো:১. যেকোনো মূল্যে দেশের প্রাচীন বিদ্যাপীঠ ঢাকা কলেজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ করতে হবে;
২. কলেজের অবকাঠামোসহ এক ইঞ্চি জমিও অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে লিখে দেওয়া যাবে না;
৩. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা ব্যক্তিস্বার্থে ও বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষা-সংকোচনমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না;
৪. অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ফেডারেল বা অন্য কোনো মডেল অনুসরণে একটি নিয়ন্ত্রণকারী বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, যেখানে ঢাকা কলেজসহ সাতটি সরকারি কলেজ স্বমহিমায় স্বাতন্ত্র্য ও ঐতিহ্য বজায় রেখে প্রতিযোগিতামূলকভাবে শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে;
৫. উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতে হবে। তাদের ‘নিজভূমে পরবাসী’ বানানোর ষড়যন্ত্র পরিহার করতে হবে;
৬. উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমের ক্ষেত্রে পাঠ্যসূচি সমাপ্ত করা, যথাসময়ে পরীক্ষা গ্রহণ ও দ্রুততম সময়ে ফলাফল প্রকাশ নিশ্চিত করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন সেশনজট মুক্ত করতে হবে;
৭. শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত যৌক্তিক করার জন্য দ্রুত শিক্ষকসংখ্যা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষার বৈষম্য নিরসনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিভাগপ্রতি ২০ থেকে ৩৫ জন শিক্ষক এবং প্রয়োজনীয় সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ বা পদায়ন করতে হবে। এ ছাড়া নতুন নতুন চাহিদাসম্পন্ন বিভাগ খুলতে হবে;
৮. শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় মেধাবৃত্তি, আবাসন–সুবিধা বৃদ্ধি, খাবারে ভর্তুকি ও শিক্ষাঋণ দিতে হবে। তাঁদের খেলাধুলা ও সহশিক্ষা কার্যক্রমের সুযোগ বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থীপ্রতি বরাদ্দ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমান করতে হবে;
৯. শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, শিক্ষাবিদ, সুশীল সমাজসহ সংশ্লিষ্ট সবার মতামতের আলোকে টেকসই ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে; এবং
১০. ঐতিহ্যবাহী এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে হাইব্রিড বা কোনো অপ্রচলিত শিক্ষাকাঠামোর পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপকরণে পরিণত করা যাবে না। কোনো অবস্থায় সমাজের নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের, বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ বন্ধ বা সীমিত করা যাবে না।
সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি মীর সরফত আলী বলেন, ১৬ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হবে। এরপরও যদি তারা এখান থেকে সরে না আসে, তাহলে প্রয়োজনবোধে সাত কলেজের সবাইকে নিয়ে একটি বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন, ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি মীর নেওয়াজ আলী নেওয়াজ, হারুনুর রশিদ হারুন, সাবেক জিএস জাকির হোসেন, সাবেক জিএস এস এ এইচ এম জাভেদসহ প্রমুখ।