ঢাকা ১২:১৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

৩৫% কন্যাশিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার

ছবি সংগৃহিত

গত ২৭ আগস্ট দুপুর থেকে নিখোঁজ ছিল ছয় বছরের মেয়েটি। শিশুর খোঁজে পরিবার থেকে এলাকায় মাইকিং করা হয়। পরে গভীর রাতে ইটভাটার পরিত্যক্ত সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার হয় শিশুটির মরদেহ। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে, মো. রাসেল (১৮) নামের এক শ্রমিক শিশুটিকে ধর্ষণের পর হত্যা করেন। ওই তরুণকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ঘটনাটি ফেনী সদর উপজেলার।

৬ অক্টোবর ছিল হুজাইফা নুসরাত আফসির (৪) জন্মদিন। অথচ সেদিনই শিশুটিকে দাফন করতে হয় বাবা প্রকৌশলী মামুনুর রশীদকে। কক্সবাজারের টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের পূর্ব পানখালীতে ফরিদ আহমেদের বাড়ির নিচতলায় গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মামুনুর রশীদ ভাড়া থাকতেন। বাড়ির লাগোয়া পুকুর থেকে ৫ অক্টোবর উদ্ধার করা হয় আফসির লাশ। সে ছিল চার ভাই–বোনের মধ্যে তৃতীয়। ওই ঘটনায় বাড়ির মালিকের স্ত্রী, ছেলেসহ সাত আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। টেকনাফ মডেল থানার ওসি আবু জায়েদ মো. নাজমুন নূর প্রথম আলোকে বলেন, আসামিদের মধ্যে দুজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সোনার কানের দুলের জন্য শিশুটিকে হত্যা করা হতে পারে।

সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, কন্যাশিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটছে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা। এ পরিস্থিতির মধ্যেই সংকট মোকাবিলা করে সামনে এগোনোর শপথ নিয়ে আজ ১১ অক্টোবর শনিবার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘আমি সেই মেয়ে, আমিই পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিই: সংকটের সামনের সারিতে মেয়েরা’।৩৫০ কন্যাশিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৩ জনকে। হত্যার শিকার হয়েছে ৮১ কন্যাশিশু। এ ছাড়া ধর্ষণচেষ্টা, পাচার, যৌন নিপীড়ন, উত্ত্যক্ত, বাল্যবিবাহসহ নানা ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুসারে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৯ মাসে ৯৯৩টি কন্যাশিশু নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ১৫টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার তথ্য সংকলিত করে সংগঠনটি জানিয়েছে, নির্যাতনের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়েছে। এ সময়ে ৩৫০ কন্যাশিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৩ জনকে। হত্যার শিকার হয়েছে ৮১ কন্যাশিশু। এ ছাড়া ধর্ষণচেষ্টা, পাচার, যৌন নিপীড়ন, উত্ত্যক্ত, বাল্যবিবাহসহ নানা ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সংকলিত করে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম জানিয়েছে, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে দেশে ৩৯০ কন্যাশিশু ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় বেশি। ২০২৪ সালের প্রথম আট মাসে মোট ২২৪ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ অনুসারে, ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড।শিশুর প্রতি সহিংসতার বিচার না হওয়াই এ ধরনের অপরাধ বাড়ার মূল কারণ। আমরা বারবারই দিবসগুলো পালন করি। কিন্তু কন্যাশিশুদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে আমাদের যে করণীয় আছে, সেদিকেও খেয়াল রাখা উচিত।ফওজিয়া মোসলেম সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

পারিবারিক সহিংসতারও শিকার হচ্ছে কন্যাশিশু। ৬ অক্টোবর লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় ছয় বছর বয়সী কন্যাশিশুকে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে বাবার বিরুদ্ধে। এলাকাবাসীর দাবি, শিশুর বাবা মো. ফারুক মাদকাসক্ত ছিলেন। তিনি মেয়েকে কুপিয়ে বাড়ির পুকুরে ফেলে দেন। লক্ষ্মীপুর সদর মডেল থানার ওসি আবদুল মোন্নাফ বলেন, এ ঘটনায় শিশুটির বাবাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, গত ৯ মাসে পারিবারিক বৃত্তে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৭ শিশুকে। এর মধ্যে ৩৬ শিশুর বয়স ছয় বছরের নিচে। তবে এর মধ্যে কন্যাশিশুর সংখ্যা আলাদা করে নেই।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশুর প্রতি সহিংসতার বিচার না হওয়াই এ ধরনের অপরাধ বাড়ার মূল কারণ। আমরা বারবারই দিবসগুলো পালন করি। কিন্তু কন্যাশিশুদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে আমাদের যে করণীয় আছে, সেদিকেও খেয়াল রাখা উচিত।’

টেকনাফের আফসি হত্যার ঘটনায় তার বাবা মামুনুর রশীদ কঠোর সাজা দাবি করেছেন। মেয়ের জন্মদিনে তিনি এক মর্মস্পর্শী চিঠি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছেন। ‘আফসির খোলাচিঠি’ শিরোনামে সেই লেখায় মেয়ের হয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমার আত্মা চায়, যারা আমার হাসি কেড়ে নিয়েছে, যারা আমার জীবনের আলো নিভিয়ে দিয়েছে—তাদের যেন এই দেশের আইন কঠোরতম শাস্তি দেয়।’

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Gojnobi biplob

Popular Post

মাহিন হত্যা মামলায় আরো এক আসামি গ্রেফতার হলো ফটিকছড়িতে

৩৫% কন্যাশিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার

প্রকাশের সময় : ০২:২৪:৩০ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫

ছবি সংগৃহিত

গত ২৭ আগস্ট দুপুর থেকে নিখোঁজ ছিল ছয় বছরের মেয়েটি। শিশুর খোঁজে পরিবার থেকে এলাকায় মাইকিং করা হয়। পরে গভীর রাতে ইটভাটার পরিত্যক্ত সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার হয় শিশুটির মরদেহ। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে, মো. রাসেল (১৮) নামের এক শ্রমিক শিশুটিকে ধর্ষণের পর হত্যা করেন। ওই তরুণকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ঘটনাটি ফেনী সদর উপজেলার।

৬ অক্টোবর ছিল হুজাইফা নুসরাত আফসির (৪) জন্মদিন। অথচ সেদিনই শিশুটিকে দাফন করতে হয় বাবা প্রকৌশলী মামুনুর রশীদকে। কক্সবাজারের টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের পূর্ব পানখালীতে ফরিদ আহমেদের বাড়ির নিচতলায় গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মামুনুর রশীদ ভাড়া থাকতেন। বাড়ির লাগোয়া পুকুর থেকে ৫ অক্টোবর উদ্ধার করা হয় আফসির লাশ। সে ছিল চার ভাই–বোনের মধ্যে তৃতীয়। ওই ঘটনায় বাড়ির মালিকের স্ত্রী, ছেলেসহ সাত আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। টেকনাফ মডেল থানার ওসি আবু জায়েদ মো. নাজমুন নূর প্রথম আলোকে বলেন, আসামিদের মধ্যে দুজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সোনার কানের দুলের জন্য শিশুটিকে হত্যা করা হতে পারে।

সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, কন্যাশিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটছে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা। এ পরিস্থিতির মধ্যেই সংকট মোকাবিলা করে সামনে এগোনোর শপথ নিয়ে আজ ১১ অক্টোবর শনিবার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘আমি সেই মেয়ে, আমিই পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিই: সংকটের সামনের সারিতে মেয়েরা’।৩৫০ কন্যাশিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৩ জনকে। হত্যার শিকার হয়েছে ৮১ কন্যাশিশু। এ ছাড়া ধর্ষণচেষ্টা, পাচার, যৌন নিপীড়ন, উত্ত্যক্ত, বাল্যবিবাহসহ নানা ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুসারে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৯ মাসে ৯৯৩টি কন্যাশিশু নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ১৫টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার তথ্য সংকলিত করে সংগঠনটি জানিয়েছে, নির্যাতনের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়েছে। এ সময়ে ৩৫০ কন্যাশিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৩ জনকে। হত্যার শিকার হয়েছে ৮১ কন্যাশিশু। এ ছাড়া ধর্ষণচেষ্টা, পাচার, যৌন নিপীড়ন, উত্ত্যক্ত, বাল্যবিবাহসহ নানা ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সংকলিত করে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম জানিয়েছে, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে দেশে ৩৯০ কন্যাশিশু ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় বেশি। ২০২৪ সালের প্রথম আট মাসে মোট ২২৪ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ অনুসারে, ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড।শিশুর প্রতি সহিংসতার বিচার না হওয়াই এ ধরনের অপরাধ বাড়ার মূল কারণ। আমরা বারবারই দিবসগুলো পালন করি। কিন্তু কন্যাশিশুদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে আমাদের যে করণীয় আছে, সেদিকেও খেয়াল রাখা উচিত।ফওজিয়া মোসলেম সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

পারিবারিক সহিংসতারও শিকার হচ্ছে কন্যাশিশু। ৬ অক্টোবর লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় ছয় বছর বয়সী কন্যাশিশুকে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে বাবার বিরুদ্ধে। এলাকাবাসীর দাবি, শিশুর বাবা মো. ফারুক মাদকাসক্ত ছিলেন। তিনি মেয়েকে কুপিয়ে বাড়ির পুকুরে ফেলে দেন। লক্ষ্মীপুর সদর মডেল থানার ওসি আবদুল মোন্নাফ বলেন, এ ঘটনায় শিশুটির বাবাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, গত ৯ মাসে পারিবারিক বৃত্তে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৭ শিশুকে। এর মধ্যে ৩৬ শিশুর বয়স ছয় বছরের নিচে। তবে এর মধ্যে কন্যাশিশুর সংখ্যা আলাদা করে নেই।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশুর প্রতি সহিংসতার বিচার না হওয়াই এ ধরনের অপরাধ বাড়ার মূল কারণ। আমরা বারবারই দিবসগুলো পালন করি। কিন্তু কন্যাশিশুদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে আমাদের যে করণীয় আছে, সেদিকেও খেয়াল রাখা উচিত।’

টেকনাফের আফসি হত্যার ঘটনায় তার বাবা মামুনুর রশীদ কঠোর সাজা দাবি করেছেন। মেয়ের জন্মদিনে তিনি এক মর্মস্পর্শী চিঠি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছেন। ‘আফসির খোলাচিঠি’ শিরোনামে সেই লেখায় মেয়ের হয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমার আত্মা চায়, যারা আমার হাসি কেড়ে নিয়েছে, যারা আমার জীবনের আলো নিভিয়ে দিয়েছে—তাদের যেন এই দেশের আইন কঠোরতম শাস্তি দেয়।’