ঢাকা ১২:১৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শহীদ হৃদয় তরুয়ার বাবার প্রত্যাশা -‘শহীদ যোদ্ধার বাবা হিসেবে যে-ই সম্মানটুকু পাইতাছি হেইডা যেন আমৃত্যু পাই’

‘কইতে কইতে একটা বছর চইল্যা গেল পোলাডার মুখে বাবা ডাক হুনি না। এর চেয়ে কষ্টের আর কি আছে ? আমি শহীদের জুলাই যোদ্ধার বাবা-এই কথাডা হুইন্যাই অ্যাহোনও মনের কষ্ট বুকে চাইপা রাখছি।

সরকার ও দেশের মানুষের কাছে আমাগো একটাই চাওয়া-জুলাই শহীদ যোদ্ধার বাবা হিসেবে যে সম্মানটুকু অ্যাহোন পাইতাছি হেইডা যেন আমৃত্যু পাই’। সন্তানহারার এক বছর হয়ে যাওয়া নিয়ে এ কথাগুলো বলেছেন জুলাই যোদ্ধা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী শহীদ হৃদয় চন্দ্র তরুয়ার বাবা রতন চন্দ্র তরুয়া। তিনি বলেন, ‘বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ এর চাইতে কষ্টের কিছুই নাই। যার সন্তান হারাইছে একমাত্র হেই বুঝে সন্তান হারানোর কি কষ্ট ও বেদনা। আমার সন্তান হারানোর এই শুণ্যতা কেউই কোনোদিন পূরণ কইরা দিতে পারবো না’।

তিনি বলেন, ‘শুধুমাত্র আমার সন্তান না, এই আন্দোলনে যত বাবা-মা’র বুক খালি হইয়াছে, যত শহীদ হইছে তাঁদের সবার খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। বিচারডা দেইখ্যা গেলে মইর‌্যাও শান্তি পামু’।   আজ ২৩ জুলাই, শহীদ হৃদয় তরুয়ার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এই দিনে মারা যায়  সে। হৃদয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল।

১৮ জুলাই চবি’র মূল ফটকের সামনে গুলিবিদ্ধ হয় হৃদয়। প্রথমে চট্টগ্রাম  মেডিকেলে পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। ২৩ জুলাই ভোরে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় হৃদয়। এ ঘটনার পর জুলাই বিপ্লবের শহীদ যোদ্ধা হিসেবে সরকারি-বেসরকারিভাবে অনেক সহায়তা পায় এ পরিবারটি। চবি’র শিক্ষার্থী হওয়ায় পবিপ্রবি কর্তৃপক্ষও হৃদয় তরুয়ার পরিবারের পাশে দাঁড়ান। হৃদয়ের বোন মিতু তরুয়াকে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে অ্যাটেনডেন্ট পদে চাকরি দেয়। এছাড়া জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শহরের সার্কিট হাউজ সড়কের গোল চত্বরটি ‘শহীদ হৃদয় তরুয়া চত্বর’ নামকরণ করা হয়।

এদিকে শহীদ হৃদয়ের বাবা রতন তরুয়া কাঠমিস্ত্রির কাজ ছেড়ে দিয়ে সরকারি সহায়তার অর্থে শহরের নতুন বাজারে চায়ের দোকান দিয়েছেন  ‘হৃদয় তরুয়া টি-ষ্টল’। এছাড়া আগের বাসা ছেড়ে নতুন ভাড়াবাসায় উঠেছেন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি মির্জাঞ্জের আন্দুয়া গ্রামে। ছেলেমেয়ের পড়াশোনার জন্য জেলা শহরে বসবাস করতো। রতন-অর্চনা দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে হৃদয় কনিষ্ঠ। মা অর্চনা রানী তরুয়া বলেন, ‘আমার হৃদয়ের মতন তো রোজ কেউ ফোন দেয়না, কেউ তো জিজ্ঞেস করেনা-মা আপনি কেমন আছেন, ভাত খাইছেন, অ্যাহোন কি করেন’ হেই দিনগুলো আমি ক্যামনে ভুলবো ? এইডা শুধু আমি জানি আর ভগবান জানেন। এর চাইতে আমার হৃদয়ের লইয়া যে-ই ভাঙা ঘরে ছিলাম হেইহানেই মহাশান্তিতে আছিলাম। হেই দিনগুলো আমি ক্যামনে ভুলমু

তিনি বলেন, ‘অরে তো ইচ্ছা করে কেউ মারছে, টার্গেট করে অরে কেউ মারছে। বিচার তো চাই। বাঁইচা থাকলে ভগবান যদি বিচার দেখায়’। তিনি বলেন, ‘অর স্বপ্ন তো অনেক ছিল। সবসময় বলতো মা আপনি এত কষ্ট করেন আমার খুব খারাপ লাগে। কবে আমার পড়াশোনাটা শেষে হবে, কবে আমি চাকরি পামু, কবে আপনার কষ্ট দূর করমু’ এইভাবে অর স্বপ্নের কোনো শ্যাষ ছিল না’।

একমাত্র বোন মিতু তরুয়া বলেন, ‘আজ এক বছর হয়ে গেল। অথচ মনে হয়না যে ভাই নেই। ভাইকে তো আর পাব না। তবে, ভাইকে যারা খুন করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে মনে শান্তি পাবো’। তিনি বলেন, ‘খোঁজ-খবর নেয়, তবে সবাই তো নেয় না। যখন তাঁদের প্রয়োজন হয় তখন যোগাযোগ করে। যখন প্রয়োজন হয় না তখন যোগাযোগ রাখে না’।  

পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক আবুল হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন জানান, ঐতিহাসিক এই মাসে সকল জুলাই শহীদ ও যোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। এ জেলায় ২৬ জন জুলাই শহীদ যোদ্ধা রয়েছে। শহীদ মিনারের পাশেই করা হচ্ছে শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভ। এছাড়া সার্কিট হাউজ সড়কটি শহীদ হৃদয় চন্দ্র তরুয়ার নামে ‘শহীদ হৃদয় তরুয়া চত্বর’ নামকরণ করা হয়েছে।

এছাড়া প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা, ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন ধরণের সহায়তা করা হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে আরও সহায়তা ও ফ্রি চিকিৎসা প্রদানের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Gojnobi biplob

Popular Post

মাহিন হত্যা মামলায় আরো এক আসামি গ্রেফতার হলো ফটিকছড়িতে

শহীদ হৃদয় তরুয়ার বাবার প্রত্যাশা -‘শহীদ যোদ্ধার বাবা হিসেবে যে-ই সম্মানটুকু পাইতাছি হেইডা যেন আমৃত্যু পাই’

প্রকাশের সময় : ০২:৩৩:১৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

‘কইতে কইতে একটা বছর চইল্যা গেল পোলাডার মুখে বাবা ডাক হুনি না। এর চেয়ে কষ্টের আর কি আছে ? আমি শহীদের জুলাই যোদ্ধার বাবা-এই কথাডা হুইন্যাই অ্যাহোনও মনের কষ্ট বুকে চাইপা রাখছি।

সরকার ও দেশের মানুষের কাছে আমাগো একটাই চাওয়া-জুলাই শহীদ যোদ্ধার বাবা হিসেবে যে সম্মানটুকু অ্যাহোন পাইতাছি হেইডা যেন আমৃত্যু পাই’। সন্তানহারার এক বছর হয়ে যাওয়া নিয়ে এ কথাগুলো বলেছেন জুলাই যোদ্ধা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী শহীদ হৃদয় চন্দ্র তরুয়ার বাবা রতন চন্দ্র তরুয়া। তিনি বলেন, ‘বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ এর চাইতে কষ্টের কিছুই নাই। যার সন্তান হারাইছে একমাত্র হেই বুঝে সন্তান হারানোর কি কষ্ট ও বেদনা। আমার সন্তান হারানোর এই শুণ্যতা কেউই কোনোদিন পূরণ কইরা দিতে পারবো না’।

তিনি বলেন, ‘শুধুমাত্র আমার সন্তান না, এই আন্দোলনে যত বাবা-মা’র বুক খালি হইয়াছে, যত শহীদ হইছে তাঁদের সবার খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। বিচারডা দেইখ্যা গেলে মইর‌্যাও শান্তি পামু’।   আজ ২৩ জুলাই, শহীদ হৃদয় তরুয়ার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এই দিনে মারা যায়  সে। হৃদয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল।

১৮ জুলাই চবি’র মূল ফটকের সামনে গুলিবিদ্ধ হয় হৃদয়। প্রথমে চট্টগ্রাম  মেডিকেলে পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। ২৩ জুলাই ভোরে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় হৃদয়। এ ঘটনার পর জুলাই বিপ্লবের শহীদ যোদ্ধা হিসেবে সরকারি-বেসরকারিভাবে অনেক সহায়তা পায় এ পরিবারটি। চবি’র শিক্ষার্থী হওয়ায় পবিপ্রবি কর্তৃপক্ষও হৃদয় তরুয়ার পরিবারের পাশে দাঁড়ান। হৃদয়ের বোন মিতু তরুয়াকে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে অ্যাটেনডেন্ট পদে চাকরি দেয়। এছাড়া জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শহরের সার্কিট হাউজ সড়কের গোল চত্বরটি ‘শহীদ হৃদয় তরুয়া চত্বর’ নামকরণ করা হয়।

এদিকে শহীদ হৃদয়ের বাবা রতন তরুয়া কাঠমিস্ত্রির কাজ ছেড়ে দিয়ে সরকারি সহায়তার অর্থে শহরের নতুন বাজারে চায়ের দোকান দিয়েছেন  ‘হৃদয় তরুয়া টি-ষ্টল’। এছাড়া আগের বাসা ছেড়ে নতুন ভাড়াবাসায় উঠেছেন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি মির্জাঞ্জের আন্দুয়া গ্রামে। ছেলেমেয়ের পড়াশোনার জন্য জেলা শহরে বসবাস করতো। রতন-অর্চনা দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে হৃদয় কনিষ্ঠ। মা অর্চনা রানী তরুয়া বলেন, ‘আমার হৃদয়ের মতন তো রোজ কেউ ফোন দেয়না, কেউ তো জিজ্ঞেস করেনা-মা আপনি কেমন আছেন, ভাত খাইছেন, অ্যাহোন কি করেন’ হেই দিনগুলো আমি ক্যামনে ভুলবো ? এইডা শুধু আমি জানি আর ভগবান জানেন। এর চাইতে আমার হৃদয়ের লইয়া যে-ই ভাঙা ঘরে ছিলাম হেইহানেই মহাশান্তিতে আছিলাম। হেই দিনগুলো আমি ক্যামনে ভুলমু

তিনি বলেন, ‘অরে তো ইচ্ছা করে কেউ মারছে, টার্গেট করে অরে কেউ মারছে। বিচার তো চাই। বাঁইচা থাকলে ভগবান যদি বিচার দেখায়’। তিনি বলেন, ‘অর স্বপ্ন তো অনেক ছিল। সবসময় বলতো মা আপনি এত কষ্ট করেন আমার খুব খারাপ লাগে। কবে আমার পড়াশোনাটা শেষে হবে, কবে আমি চাকরি পামু, কবে আপনার কষ্ট দূর করমু’ এইভাবে অর স্বপ্নের কোনো শ্যাষ ছিল না’।

একমাত্র বোন মিতু তরুয়া বলেন, ‘আজ এক বছর হয়ে গেল। অথচ মনে হয়না যে ভাই নেই। ভাইকে তো আর পাব না। তবে, ভাইকে যারা খুন করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে মনে শান্তি পাবো’। তিনি বলেন, ‘খোঁজ-খবর নেয়, তবে সবাই তো নেয় না। যখন তাঁদের প্রয়োজন হয় তখন যোগাযোগ করে। যখন প্রয়োজন হয় না তখন যোগাযোগ রাখে না’।  

পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক আবুল হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন জানান, ঐতিহাসিক এই মাসে সকল জুলাই শহীদ ও যোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। এ জেলায় ২৬ জন জুলাই শহীদ যোদ্ধা রয়েছে। শহীদ মিনারের পাশেই করা হচ্ছে শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভ। এছাড়া সার্কিট হাউজ সড়কটি শহীদ হৃদয় চন্দ্র তরুয়ার নামে ‘শহীদ হৃদয় তরুয়া চত্বর’ নামকরণ করা হয়েছে।

এছাড়া প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা, ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন ধরণের সহায়তা করা হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে আরও সহায়তা ও ফ্রি চিকিৎসা প্রদানের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।