
“গরুর যে বুদ্ধি আছে, সেটাও অনেক মানুষের নেই”—এই কথাটি নিছক কৌতুক নয়, বরং এক নির্মম বাস্তবতার স্পষ্ট উচ্চারণ। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস-২০২৫ উপলক্ষে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় যখন এই বাক্য উচ্চারণ করেন, তখন উপস্থিত অনেকে হয়তো হেসে উঠেছিলেন।
কিন্তু আমার মনে বাজতে থাকে অন্য রকম এক শব্দ—আত্মসমালোচনার ধ্বনি। ফরিদা আখতার আরও বলেছিলেন, “গরু-ছাগল তামাক পাতা খায় না। অথচ অনেক মানুষ জানার পরও খায়!” একটা গরুও বুঝতে পারে কী তার শরীরের জন্য ক্ষতিকর, অথচ আমরা—মানুষ নামের ‘সৃষ্টির সেরা জীব’—ফুসফুস জ্বালিয়ে ধোঁয়া টেনে চলেছি প্রতিদিন, জেনে-বুঝেও। আমার ধুমপানের শুরু: নিষ্পাপ শৈশবে বিষবাষ্প।। আমি নিজেই দীর্ঘদিন ধূমপানের সাথে ছিলাম গভীরভাবে জড়িয়ে।
শৈশবেই এই অভ্যাসের সূচনা—দাদার হুক্কায় তামাক জ্বালিয়ে দেওয়ার সেই ছোট্ট মুহূর্ত থেকেই যেন বিষ ঢুকে পড়ে শিরায়-শিরায়। আশির দশকের গ্রামীণ জীবনে আমরা—চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো ভাই কিংবা সহপাঠীরা—তামাককে কখনো ভয় পাইনি, বরং মনে করেছি, এটা বড় হওয়ার একটা চিহ্ন। তখন গ্রামে বাহারি সিগারেট ছিল না। ছিল কেবল হুক্কা আর কাঁচা তামাক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় আমরা ১৮ জন বন্ধু মিলে গঠন করেছিলাম ‘বিড়ি সমিতি’! নিয়ম ছিল, প্রতিদিন স্কুলে যেতে হবে একটি করে ‘সুবোধ বিড়ি’ হাতে নিয়ে। না আনলে দিতে হতো দশ পয়সা জরিমানা। তবে সেই সমিতির দুজন সদস্য বিড়ি খেত না—তাদের একজন ছিল আমার বন্ধু তৌহিদ, যে আজও ধূমপানের কাছে হার মানেনি। শিক্ষা, শ্রদ্ধা আর দ্বৈত জীবন: পঞ্চম শ্রেণি পেরিয়ে আমি আর তৌহিদ ভর্তি হই নিজগ্রাম কৈলাটি ফতেপুর দাখিল মাদ্রাসায়।
ওর প্রতি তখন থেকেই এক ধরনের শ্রদ্ধা জন্মায়। এরপর গণমাধ্যমে কাজ শুরু করি এবং পাশাপাশি গড়ে তুলি “মীর হোসাইন কিন্ডারগার্টেন”—আমার স্বপ্নের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু আমি তখনও ধূমপান ছাড়তে পারিনি। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সামনে ধূমপান না করলেও তারা জানতো—স্যার ধোঁয়া তোলেন। কানে আসত—“স্যার বিড়ি খান।” ভীষণ বিব্রত হতাম। লজ্জায় মাথা নোয়াত, কিন্তু এই অভ্যাসের দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে পারছিলাম না। ঘুম ভাঙানো মুহূর্ত: আমার বড় মেয়ে তখন আড়াই বছরের শিশু। এক শীতের সকালে তাকে মজা খেতে দিয়ে বাড়ির সামনের দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছি। সে খালি পায়ে এসে কোলে উঠে বলল, “বাবা, দাও আমিও খাব।”
সেই মুহূর্তে যেন আমার ঘুম ভেঙে গেল। সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। সাথে পা দিয়ে পিষেও দিলাম। সেদিনই উপজেলা সদরে গিয়ে এক সিনিয়র গণমাধ্যম সহকর্মীর সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করি। তিনি বললেন, তার মেয়েও ধূমপানে বিরক্তি প্রকাশ করেছে। আমরা দুজনেই সেদিন প্রতিজ্ঞা করি আর নয়। সেদিন আমি শেষবারের মতো স্টার সিগারেটে টান দিয়েছিলাম, আর তিনি গোল্ডলিফে। প্রতিজ্ঞা ও পুরস্কার: আজ বহু বছর হয়ে গেছে। সেই প্রতিজ্ঞা আজও অটুট। ধূমপান ছাড়ার পর যে শারীরিক পরিবর্তন পেয়েছি তা ভাষায় বোঝানো যাবে না। কাশি কমেছে, কপকাশ নেই, ফুসফুস এখন অনেক হালকা লাগে। সবচেয়ে বড় অর্জন—আমার মেয়ে এখন গর্ব করে বলে, “আমার বাবা ধূমপান করে না।
” আমার স্ত্রী এখন গর্ব করে বলে সে (আমি) ধূমপান করি না।” আমি শুধু নিজেকে ছাড়িয়ে উঠিনি, অনেক সহকর্মী, রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাকেও এই অভ্যাস ত্যাগে উৎসাহিত করেছি। এটা আমার জীবনের অন্যতম প্রাপ্তি। সমাজ ও রাষ্ট্রের করণীয়: ফরিদা আখতারের বক্তব্য শুধু একজন উপদেষ্টার দৃষ্টিভঙ্গি নয়, বরং তা আমাদের জাতীয় মনস্তত্ত্বে আঘাত। বাংলাদেশে প্রতি বছর তামাকজনিত রোগে প্রাণ হারান প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ। অথচ এগুলোর বেশিরভাগই প্রতিরোধযোগ্য। আমাদের প্রয়োজন: *তামাকজাত পণ্যের বিপণনে কঠোর নিয়ন্ত্রণ। * ই-সিগারেটসহ নিকোটিন বিকল্প নিষিদ্ধ ঘোষণা। * স্কুল-কলেজে সচেতনতামূলক কার্যক্রম। *গণমাধ্যমে তামাকবিরোধী বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। যে কৌশলে জয়ী: আমি যখন ধুমপান ত্যাগ করি তখন নিজে থেকে একটি কৌশল অবলম্বন করি।
তা হলো যেই আমার সামনে সিগারেট টানতো আমি তাকে নিরুৎসাহ করতাম। অর্থ অপচয়,শারীরিক ক্ষতিসহ নানান দিক উপস্থাপন করিতাম। আমার সামনে কেউ সিগারেট টানলে তাকে নিরুৎসাহিত করি। এই সবকটি আমাকে জয়ী করেছে। আপনি যদি সিগারেট বা ধুমপান ছাড়তে চান তাহলে আমার ছোট কৌশলটি অবলম্বন করতে পারেন। আশাকরি কাজে আসবে। পরিশেষ : মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তার চিন্তা-শক্তিতে, আচরণে, সিদ্ধান্তে। কিন্তু যদি গরু-ছাগলও জানে কোনটা খাওয়া উচিত নয়, আর আমরা জেনে-বুঝে বিষ খাই—তাহলে সত্যিই আমাদের সচেতনতা নিয়ে ভাবতে হবে। আজকে যারা ধূমপান করেন, তাদের জন্য আমার গল্পটি একটি ডাক “জীবন বাঁচান, ভবিষ্যৎ গড়ুন”। তামাককে ‘মাসকুলিন ফ্যাশন’ নয়, বরং মৃত্যুর জাল হিসেবেই দেখুন। আপনার ফেলে দেওয়া একটা সিগারেট হয়তো আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎকে ধোঁয়ার চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছ করে তুলবে।