ঢাকা ১২:১০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পিরোজপুরে এমদাদুল হকের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে এখনও বিলাপ করছেন মা

ছবি সংগৃহীতঃ

পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার মো. এমদাদুল হক ঢাকায় জীবিকার তাগিদে প্রাইভেটকার চালাতেন। মাসিক ২০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে বাবা-মা ও পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। মায়ের ওষুধ থেকে শুরু করে সংসারের সব খরচ তিনিই বহন করতেন। পরিবারের স্বপ্নগুলো যেন এগোচ্ছিল এমদাদুলের হাত ধরেই।

কিন্তু সেই স্বপ্ন থেমে যায় ২০২৪ সালের ২০ জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে ঢাকার উত্তর বাড্ডায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তিনি। আন্দোলনে যেতে মা নিষেধ করেছিলেন। মৃত্যুর আগের রাতে মা-ছেলের শেষ কথোপকথন হয়। প্রতিদিন সকালবেলা মা তাকে ফোন করে ঘুম থেকে তুলতেন। সেদিন ইচ্ছে করেই ফোন দেননি মা, ভেবেছিলেন হয়তো ছেলে ঘুমিয়ে থাকলে আন্দোলনে যাবে না। কে জানত, ঘুম ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া সেই ছেলেটি আর কোনোদিন ঘরে ফিরবে না। ঘটনার দিন উত্তর বাড্ডা এলাকায় কপালের মাঝ বরাবর গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান এমদাদুল। শহীদ এমদাদুলের কবরের পরিচর্যা করছেন বাবা আবদুস ছোবাহান, পাশে দাঁড়িয়ে আছেন তার মা। ছবি: সংগৃহীত

শহীদ এমদাদুল হক পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলার ধাওয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা। মৃত্যুর খবর পেয়ে তার মামা ছুটে আসেন, পরে পরিবারের সদস্যরা লাশ গ্রামে এনে দাফন করেন। এমদাদুল ছিলেন মিশুক স্বভাবের, ফুটবলপ্রেমী তরুণ। তার মৃত্যুতে গ্রামজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। এলাকাবাসীর কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রিয় একজন মানুষ।

প্রায় এক বছর পার হলেও এখনও শোকে ভেঙে পড়েছেন তার বাবা-মা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাবা আব্দুস সোবহান হাওলাদার এখন কর্মহীন। আগে ঢাকায় রিকশা চালাতেন, এখন কোনো কাজ করতে পারেন না। বড় ভাই চট্টগ্রামে গার্মেন্টসে কাজ করতেন, ভাইয়ের মৃত্যুর পর সে কাজ ছেড়ে গ্রামে ফিরে এসেছেন। এখন মাঝেমধ্যে দিনমজুরের কাজ করেন। আর মা হাসিনা বেগম? প্রতিদিন একবার করে ছেলের কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকেন। কান্নায় ভেঙে পড়েন ছেলের স্মৃতি মনে পড়লে। বলেন, ‘আমার ছেলে তো আর ফিরবে না। কিন্তু যেটা বেঁচে আছে, যদি তার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিত সরকার, তাহলে আমাদের জীবনটা অন্তত একটু শান্তিতে কাটাতে পারতাম।’

পরিবার সূত্রে জানা যায়, এমদাদুলের মৃত্যুর পর বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে সহায়তা হিসেবে মোট প্রায় ১১ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এর মধ্যে জুলাই ফাউন্ডেশন ৫ লাখ, বিএনপি ১ লাখ, জামায়াতে ইসলামী ২ লাখ, পিরোজপুর জেলা পরিষদ ২ লাখ এবং ভান্ডারিয়া উপজেলা পরিষদ ১৫ হাজার টাকা দেয়। এই অর্থ দিয়ে দোয়া মাহফিল, বাবা-মায়ের চিকিৎসা, এবং কিছু টাকা ব্যাংকে জমা রেখে এখন সেখান থেকে মুনাফা পেয়ে সংসার চলছে।

তবে পরিবারটির দাবি, এই সহায়তা সাময়িক। তারা চায়, শহীদ এমদাদুলের বড় ভাইয়ের জন্য যেন সরকার একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়। যাতে পরিবারটি সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারে। শহীদ এমদাদুলের বাবা বলেন, ‘আমার যে ছেলে সংসার চালাতো সে তো মারা গেছে। আমি নিজেও কিছু করতে পারি না। সরকার যদি আমার আরেক ছেলের জন্য কিছু একটা করতো, তাহলে আমাদের অনেক উপকার হতো।’
বিজ্ঞাপন

এমদাদুলের মামাও একই দাবি জানান। বলেন, এই ছেলেটাই ছিল ভরসা। তার মৃত্যুর পর পরিবার অসহায় হয়ে পড়ে। সরকার যদি তার ভাইকে কাজের সুযোগ দেয়, পরিবারটা একটু ভালোভাবে চলতে পারবে।’

স্থানীয় বাসিন্দা মো. মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘শহীদ পরিবারটির প্রতি মানবিক দৃষ্টি দেওয়া এখন জরুরি। দেশের জন্য জীবন দেওয়া একজন তরুণের পরিবার আজ কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। সরকারের উচিত তাদের জন্য স্থায়ী সমাধানের ব্যবস্থা করা।’

 

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Gojnobi biplob

Popular Post

মাহিন হত্যা মামলায় আরো এক আসামি গ্রেফতার হলো ফটিকছড়িতে

পিরোজপুরে এমদাদুল হকের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে এখনও বিলাপ করছেন মা

প্রকাশের সময় : ১১:০১:৪৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫

ছবি সংগৃহীতঃ

পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার মো. এমদাদুল হক ঢাকায় জীবিকার তাগিদে প্রাইভেটকার চালাতেন। মাসিক ২০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে বাবা-মা ও পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। মায়ের ওষুধ থেকে শুরু করে সংসারের সব খরচ তিনিই বহন করতেন। পরিবারের স্বপ্নগুলো যেন এগোচ্ছিল এমদাদুলের হাত ধরেই।

কিন্তু সেই স্বপ্ন থেমে যায় ২০২৪ সালের ২০ জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে ঢাকার উত্তর বাড্ডায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তিনি। আন্দোলনে যেতে মা নিষেধ করেছিলেন। মৃত্যুর আগের রাতে মা-ছেলের শেষ কথোপকথন হয়। প্রতিদিন সকালবেলা মা তাকে ফোন করে ঘুম থেকে তুলতেন। সেদিন ইচ্ছে করেই ফোন দেননি মা, ভেবেছিলেন হয়তো ছেলে ঘুমিয়ে থাকলে আন্দোলনে যাবে না। কে জানত, ঘুম ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া সেই ছেলেটি আর কোনোদিন ঘরে ফিরবে না। ঘটনার দিন উত্তর বাড্ডা এলাকায় কপালের মাঝ বরাবর গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান এমদাদুল। শহীদ এমদাদুলের কবরের পরিচর্যা করছেন বাবা আবদুস ছোবাহান, পাশে দাঁড়িয়ে আছেন তার মা। ছবি: সংগৃহীত

শহীদ এমদাদুল হক পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলার ধাওয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা। মৃত্যুর খবর পেয়ে তার মামা ছুটে আসেন, পরে পরিবারের সদস্যরা লাশ গ্রামে এনে দাফন করেন। এমদাদুল ছিলেন মিশুক স্বভাবের, ফুটবলপ্রেমী তরুণ। তার মৃত্যুতে গ্রামজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। এলাকাবাসীর কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রিয় একজন মানুষ।

প্রায় এক বছর পার হলেও এখনও শোকে ভেঙে পড়েছেন তার বাবা-মা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাবা আব্দুস সোবহান হাওলাদার এখন কর্মহীন। আগে ঢাকায় রিকশা চালাতেন, এখন কোনো কাজ করতে পারেন না। বড় ভাই চট্টগ্রামে গার্মেন্টসে কাজ করতেন, ভাইয়ের মৃত্যুর পর সে কাজ ছেড়ে গ্রামে ফিরে এসেছেন। এখন মাঝেমধ্যে দিনমজুরের কাজ করেন। আর মা হাসিনা বেগম? প্রতিদিন একবার করে ছেলের কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকেন। কান্নায় ভেঙে পড়েন ছেলের স্মৃতি মনে পড়লে। বলেন, ‘আমার ছেলে তো আর ফিরবে না। কিন্তু যেটা বেঁচে আছে, যদি তার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিত সরকার, তাহলে আমাদের জীবনটা অন্তত একটু শান্তিতে কাটাতে পারতাম।’

পরিবার সূত্রে জানা যায়, এমদাদুলের মৃত্যুর পর বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে সহায়তা হিসেবে মোট প্রায় ১১ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এর মধ্যে জুলাই ফাউন্ডেশন ৫ লাখ, বিএনপি ১ লাখ, জামায়াতে ইসলামী ২ লাখ, পিরোজপুর জেলা পরিষদ ২ লাখ এবং ভান্ডারিয়া উপজেলা পরিষদ ১৫ হাজার টাকা দেয়। এই অর্থ দিয়ে দোয়া মাহফিল, বাবা-মায়ের চিকিৎসা, এবং কিছু টাকা ব্যাংকে জমা রেখে এখন সেখান থেকে মুনাফা পেয়ে সংসার চলছে।

তবে পরিবারটির দাবি, এই সহায়তা সাময়িক। তারা চায়, শহীদ এমদাদুলের বড় ভাইয়ের জন্য যেন সরকার একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়। যাতে পরিবারটি সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারে। শহীদ এমদাদুলের বাবা বলেন, ‘আমার যে ছেলে সংসার চালাতো সে তো মারা গেছে। আমি নিজেও কিছু করতে পারি না। সরকার যদি আমার আরেক ছেলের জন্য কিছু একটা করতো, তাহলে আমাদের অনেক উপকার হতো।’
বিজ্ঞাপন

এমদাদুলের মামাও একই দাবি জানান। বলেন, এই ছেলেটাই ছিল ভরসা। তার মৃত্যুর পর পরিবার অসহায় হয়ে পড়ে। সরকার যদি তার ভাইকে কাজের সুযোগ দেয়, পরিবারটা একটু ভালোভাবে চলতে পারবে।’

স্থানীয় বাসিন্দা মো. মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘শহীদ পরিবারটির প্রতি মানবিক দৃষ্টি দেওয়া এখন জরুরি। দেশের জন্য জীবন দেওয়া একজন তরুণের পরিবার আজ কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। সরকারের উচিত তাদের জন্য স্থায়ী সমাধানের ব্যবস্থা করা।’