ছবি সংগৃহিত
ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের অভূতপূর্ব ফলের কারণ এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে আলোচনার মধ্যেই কিছু প্রশ্ন উঠে আসা জরুরি—স্বল্পমেয়াদি অর্জনের জন্য জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির কি দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি নিল? ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবির জিতল, কিন্তু তারা কি রাজনীতিতে হারল?
ছাত্রশিবির তো নিজ নামে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, তাই তারা যা যা করেছে, সেগুলোর দায় পুরোপুরি ছাত্রশিবিরকে দেওয়া যাবে না—এই নিবন্ধের আলোচনায় এ-জাতীয় অহেতুক আলাপকে বিবেচনায় রাখা হয়নি।
ডাকসু নির্বাচন সামনে রেখে ছাত্রশিবিরের ৩৬ দফা ইশতেহার মূলত ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক মান বাড়ানোসহ ক্যাম্পাসে ছাত্রদের জন্য নানা রকম কল্যাণমুখী পদক্ষেপকে ভিত্তি করে। অথচ ছাত্রশিবিরের গঠনতন্ত্রের প্রস্তাবনার পুরোটাই ইসলামে বিশ্বাস এবং সেটা প্রতিষ্ঠিত করা-সংক্রান্ত। এ ছাড়া দেখে নেওয়া যাক গঠনতন্ত্রের কিছু অংশ—
কর্মসূচি: ১. তরুণ ছাত্রসমাজের কাছে ইসলামের আহ্বান পৌঁছে তাদের মধ্যে ইসলামিক জ্ঞান অর্জন এবং বাস্তব জীবনে ইসলামের পূর্ণ অনুশীলনের দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত করা; ২. যেসব ছাত্র ইসলামি জীবনবিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশ নিতে প্রস্তুত, তাদের সংগঠনের অধীন সংঘবদ্ধ করা; ৩. এই সংগঠনের অধীন সংঘবদ্ধ ছাত্রদের ইসলামি জ্ঞান প্রদান এবং আদর্শ চরিত্রবান রূপে গড়ে তুলে জাহেলিয়াতের সমস্ত চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মী হিসেবে গড়ার কার্যকর ব্যবস্থা করা; ৪. আদর্শ নাগরিক তৈরির উদ্দেশ্যে ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে সংগ্রাম এবং ছাত্রসমাজের প্রকৃত সমস্যা সমাধানের সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান; ৫. অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক গোলামি থেকে মানবতার মুক্তির জন্য ইসলামি সমাজ বিনির্মাণে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো।
বলা বাহুল্য, এসব লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচির কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি ইশতেহারে। এটা একেবারেই স্পষ্ট—ছাত্রশিবির তাদের সংগঠনের নামের পাশে থাকা ‘ইসলাম’ নিয়ে অন্তত খুব বেশি ভাবছে না।
শুধু তা-ই নয়, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থীকে দেখা গেছে হিজাব পরিধান করছেন না—এমন নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে এমনভাবে চলাফেরা করছেন, যেটা আগে ছাত্রশিবিরের নেতাদের ক্ষেত্রে দেখা যেত না। শুধু সেটাই নয়, পোশাক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ছাত্রশিবিরের কর্মী-সদস্যরা যেভাবে ইসলামের অনুশাসন মেনে চলেন, সেটাও অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।
ছাত্রশিবিরের যে গঠনতন্ত্র আছে, তাতে একজন সদস্য এটা করতে পারেন কি না—এ প্রশ্ন আসবেই। গঠনতন্ত্রে সদস্যদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘...তাঁর জীবনে ইসলাম নির্ধারিত ফরজ ও ওয়াজিবসমূহ যথাযথভাবে পালন করেন, কবিরা গুনাহসমূহ থেকে দূরে থাকেন এবং সংগঠনের লক্ষ্য ও কর্মসূচির বিপরীত কোনো সংস্থার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রাখেন, তাহলে তিনি এ সংগঠনের সদস্যপদ লাভ করতে পারেন।’
অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলগুলো এমন সব কৌশল অবলম্বন করে, যেটা তাদের দলের নীতি-আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়। সেটা গ্রহণ করার একধরনের মানসিকতা আমাদের মতো দেশের নাগরিকদের মধ্যে থাকে। তবে এ কথা অন্য সব রাজনৈতিক দলের জন্য প্রযোজ্য হলেও আদর্শভিত্তিক (বিশেষ করে ইসলামিক) রাজনৈতিক দলের জন্য বিষয়টা এত সরল নয়।
নানা দিকে ছাত্রশিবিরের এই নির্বাচনী কৌশল খুবই প্রশংসিত হয়েছে। অনেকেই বলছেন, এর মাধ্যমে ছাত্রশিবির অনেকটা লিবারেল রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রদর্শন করেছে, যা স্বাগত জানানো উচিত। নির্বাচন কৌশলের খেলা, সন্দেহ নেই।
অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলগুলো এমন সব কৌশল অবলম্বন করে, যেটা তাদের দলের নীতি-আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়। সেটা গ্রহণ করার একধরনের মানসিকতা আমাদের মতো দেশের নাগরিকদের মধ্যে থাকে। তবে এ কথা অন্য সব রাজনৈতিক দলের জন্য প্রযোজ্য হলেও আদর্শভিত্তিক (বিশেষ করে ইসলামিক) রাজনৈতিক দলের জন্য বিষয়টা এত সরল নয়।
আর সব ধর্মের মতো ইসলামেরও নানা রকম ‘স্কুল অব থট’ আছে। সাংবিধানিক ধারায় রাজনীতি করা ইসলামি দলগুলোর মধ্যেও চিন্তাগত দুস্তর ব্যবধান আছে। এ ছাড়া এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ইসলাম থেকে পুরোপুরি খারিজ করে দেওয়ার প্রবণতাও রয়েছে।
শেখ হাসিনার সময়ে দেশে অন্তত তিনটি নির্বাচন হয়নি। ফলে জনগণের ভোট দেওয়ার প্রবণতা আমরা বুঝতে পারিনি। কিন্তু রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এই আলোচনা আছে, এই সময়টাতে দেশের মানুষের ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা বেড়েছে। ফলে ইসলামি রাজনৈতিক দলের ভোট অনেক বাড়বে।
অনেকে অনুমান করছেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর ভালো ফল অনেককে চমকে দিতে পারে। ওপরে উল্লেখিত দুই ছাত্র সংসদের নির্বাচনের পরপরই ব্যবসায়ী নেতাদের জামায়াতের আমিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে অনেকে এ প্রবণতার পূর্বাভাস হিসেবেই দেখতে চান।
জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী কতটা ভালো বা কতটা খারাপ ফল করবে, সেটা এই নিবন্ধে বিশ্লেষণের বিষয় নয়।তবে এটা যৌক্তিকভাবেই অনুমান করা যায়, ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের ফলাফলের পর জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী জনগণের সামনে ছাত্র সংসদগুলোর মতো একই ধরনের কল্যাণমুখী পদক্ষেপকে সামনে নিয়ে আসবে। তাদের ইশতেহার ও প্রচারণায় ধর্ম নিয়ে ‘পবিত্র কোরআন-সুন্নাহর বাইরে কোনো আইন প্রণয়ন হবে না’—এমন দায়সারা গোছের বক্তব্যের (বিএনপি বা আওয়ামী লীগও এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছে) চেয়ে খুব বেশি কিছু থাকবে না।
অথচ দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা মাঝেমধ্যেই বলছেন, ক্ষমতায় গেলে তাঁরা শরিয়াহ আইন কায়েম করবেন। মুখে যা-ই বলুন না কেন, জামায়াতে ইসলামীর নেতারা এটা সম্ভবত বিশ্বাস করেন না, এ নির্বাচনেই তাঁরা জিতে ক্ষমতায় যাবেন। কিন্তু তাঁদের মুখে এমন বক্তব্য এবং এমন শরীরী ভাষা দেখা, যা তাঁদের নির্বাচনে খুবই ভালো করার আত্মবিশ্বাস প্রদর্শন করে।
আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে, এটাই ছিল মোক্ষম সময়, যখন জামায়াতে ইসলামী তাদের শরিয়াহর রূপরেখা জনগণের সামনে আনবে এবং সেটাকেই তাদের প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি করে তুলবে। এখন পর্যন্ত অন্তত সেই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
দুটি ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রশিবির অভাবনীয় সাফল্য পেলেও সেটা তাদের রাজনীতির মাধ্যমে হয়নি। তারা তাদের এমনভাবে পরিবর্তন করছে, যেটা আসলে ভোটের মাঠের বাস্তবতা এবং চাহিদা। তারা নির্বাচনে জিতলেও পরাজিত হয়েছে তাদের রাজনীতি। ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো প্রমাণ করল, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এখনো মধ্যপন্থী কল্যাণমুখী রাজনীতি চায়; ধর্মভিত্তিক পরিচয়বাদী রাজনীতি তারা আগের মতোই প্রত্যাখ্যান করে।
এই নিবন্ধের আলাপ এখানেই শেষ। কিন্তু একটা নতুন প্রশ্ন করে রাখতে চাই পরবর্তী আলোচনার জন্য। জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি দেখলে মনে হয়, তাদের গঠনতন্ত্রে যা-ই লেখা থাকুক না কেন, তারা বেশ খানিকটা বিএনপি হয়ে উঠছে। তাহলে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কেমন হওয়া উচিত বিএনপির রাজনীতি?
সম্পাদক ও প্রকাশক:- গজনবী বিপ্লব
নেত্রকোণা অফিস:- গজনবী ভিলা, সাতবেরিকান্দা, নেত্রকোণা সদর, নেত্রকোণা