কেন্দ্রের বাইরে; প্রান্তের সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা" নজরুল ইসলাম তমাল, কান্ট্রি এডিটর,ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
০১. আমার ভাবনায় একজন জেলার সাংবাদিক হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা, ত্যাগ, লড়াই আর অন্তর্দৃষ্টি। সবকিছুই এক ধরনের প্রামাণ্য দলিল। যা ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষর। আমার মনেহয় আপনার দেখা অভিজ্ঞতার বিষয়গুলো দেশের প্রান্তিক সাংবাদিকের নেশা থেকে পেশা, জীবন থেকে বাস্তবতার সবগুলো বিষয়ে ভালভাবেই বুঝিয়ে দেয়, শেখায়। যেকারণে আপনাদের দায়িত্ববোধকে এড়িয়ে যাওয়া সহজ নয়।
আচ্ছা আপনার যারা জেলা শহরের অলিগলি থেকে গ্রামের মেঠোপথ বা পাহাড়ি দুর্গম এলাকা থেকে নদী-হাওর বাওরের আনাচে কানাচে সাংবাদিকতা করছেন বা করবেন, কিন্তু কেন, কি জন্য? বলছি- সাংবাদিকতার বাহ্যিক চাকচিক্য, আর কিছুটা নিজস্ব প্রভাবের বলয় দেখার পর আপনাদের মাঝে একটা নেশা বা আসক্তি তৈরি করে, তাই না! কখনো কি গভীরভাবে ভেবে দেখেছেন, সাংবাদিক কি, সাংবাদিক আসলে কে? আপনার সাথে পেশাগত সাংবাদিকের মিল-অমিল আছে কি না! আসলে আপনার পরিচয় কোনটা হওয়া উচিত! সাংবাদিক! নাকি তথ্য দাতা! এই কাজে যুক্ত হওয়ার আগে ভেবে দেখেছেন কি- সাংবাদিক হিসাবে নিজেকে পরিচিত করতে হলে আপনার কি করা দরকার, কি ধরনের যোগ্যতা থাকা দরকার? আমি মনে করিনা এসব কথা কেউ একবারের জন্য হলেও ভেবে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছেন বা নিতে চাইছেন! বড় কথা সাংবাদিক হতে হলে এসবের কোন দরকার আছে বলে কখনো আপনারা মনে করেন না। বরং সাংবাদিক পরিচয় দেয়াটাকে স্বাচ্ছন্দ্য এবং কিছু সুবিধা আদায়ের কৌশল বা সেকেন্ডারি অপশন ধরে নিয়ে এই কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। যেখানে আগ্রহী শিক্ষিত-স্বল্প শিক্ষিতরা সাংবাদিক হয়ে ওঠার চেষ্টায় উঠে পড়ে লেগে রয়েছে। এসব বিষয় যদি সত্যি হয়-তাহলে জেলা থেকে পেশাজীবী সাংবাদিক হয়ে ওঠা কঠিন। এতে প্রকৃত সাংবাদিকের বদলে আগাছা সাংবাদিক ও ভুঁইফোঁড় গণমাধ্যমের দাপটে সাংবাদিকতার মতো মহৎ পেশা সমালোচিত ও কলঙ্কিত হতে থাকবেই। হলুদ বলেন আর ধান্দাবাজ বলেন, এমন অসৎ সুবিধাবাদীদের কাছে মুল সাংবাদিকতা বারবার পরাজিত হবেই। বাড়তে থাকবে নতুন নতুন নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান আর সংগঠনের দাপট। যেখানে আপনারা কখনো সাংবাদিক হয়ে উঠতে পারবেন না নিশ্চিত। সেসব যুক্তি আলোচনার পথ অনেক দীর্ঘ। যাইহোক-আপনাদের জায়গায়, আপনাদের মতো করে যদি আমার ভাবনাগুলো লিখি, তাহলে প্রথম কথা আসে- কে আমি? কেন লিখছি? কেন ছবি তুলছি? একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি জটিল, বহুমাত্রিক ও গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়ের ধারক। আর “আমি কে?” এই প্রশ্নটা খুবই গভীর, একজন সাংবাদিক যিনি শুধু পেশাগত নয়, নৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতার সাথেও জড়িত।
১. পেশাগত পরিচয়: • আমি জেলার সকল বিষয়ের তথ্য সংগ্রাহক ও বিশ্লেষক • আমি সত্যের অনুসন্ধানী • আমি স্থানীয় গণমানুষের মুখপাত্র • আমি জনস্বার্থ রক্ষার একান্ত চেষ্টাকারী আমার কাজ শহরের মূলধারার সাংবাদিকতার চেয়ে হয়তো কম আলোচিত, কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে অনেক বেশি প্রভাবশালী। কারণ আমি বাস্তবতার সবচেয়ে বেশি কাছে থাকি। ২. সামাজিক পরিচয়: • আমি এলাকার দুর্বল, নিরীহ মানুষের কণ্ঠস্বর • আমি স্থানীয় প্রশাসন, ক্ষমতাশালী, জেলার নীতি নির্ধারক ও জনগণের মধ্যস্থকারী • আমি সমাজের ভালো-মন্দ, সাফল্য-ব্যর্থতার লিপিকার, প্রত্যক্ষদর্শী আমার একটি প্রতিবেদন হয়তো কারো কোন কাজে আসে না, আবার একটি প্রতিবেদন কারও অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারে, আমার কোনো একটি প্রতিবেদন নীতি নির্ধারকদের সতর্ক করতে পারে, জনস্বার্থ বিরোধী কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে, সর্বপরি আমার প্রতিবেদন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ঐতিহাসিক দলিল হয়ে উঠতে পারে। ৩. নৈতিক পরিচয়: • আমি ন্যায় ও নিরপেক্ষতার প্রতিনিধি, সততা, সাহস ও মানবিকতার প্রতীক • আমি দল বা কোন পক্ষের নই, গণমানুষের হয়ে কথা বলা মানুষ • আমি নিজের গলায় নয়, অন্যের সুখ দুঃখে কলম ও ক্যামেরা ধরি ৪. সাংস্কৃতিক পরিচয়: • আমি স্থানীয়তা ও ঐতিহ্যের বাহক, নিজ এলাকার ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাসের ধারক • আমি শহরের চোখে গ্রামের বাস্তবতা তুলে ধরি তাহলে, আপনার পরিচয় হওয়া উচিত, আপনি জেলার সেই সাংবাদিক, যিনি সত্য, ন্যায় ও গণমানুষের পক্ষে দাঁড়ান। আপনি পেশায় সাংবাদিক, নৈতিকতায় মানুষ আর দায়িত্বে সমাজকর্মী। কেন লিখছি? এই প্রশ্নের উত্তর- আপনার লেখা আপনার ছবি গণমাধ্যমের আত্মা। এটি পাঠক/দর্শককে জানায়, আপনি কোন দায়, বোধ বা অভিজ্ঞতা থেকে কলম তুলে নিয়েছেন, ছবি তুলছেন। কেন লিখছি? কেন ছবি তুলছি? আমি লিখছি কারণ-জেলার সাংবাদিকতা শুধু খবর সংগ্রহ নয়, এটা জীবন দেখার এবং আরো জীবন বোঝার এক অভিজ্ঞতা। আমি মাঠে ঘুরে, পায়ে হেঁটে, গরিবের ঘাম ছুঁয়ে যেসব কথা জানি, তা শহরের কাচঘেরা অফিস থেকে দেখা যায় না। আমি লিখছি, ছবি তুলছি কারণ-এই পেশায় দায়িত্ব আছে, কিন্তু স্বীকৃতি কম। সংগ্রাম আছে, কিন্তু সহানুভূতি নেই। ভুল বোঝাবুঝি আছে, কিন্তু বোঝার চেষ্টা নেই। আমি লিখছি, ছবি তুলছি কারণ-আমার সহকর্মীরা প্রতিদিন নিজেদের সুরক্ষা, পরিবারের চাপ, পেশাগত দৌরাত্ম্য, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং সামাজিক অবমূল্যায়নের মাঝেও খবর গণমানুষের কাছে পৌঁছে দেয়। অথচ এই গল্পগুলো কেউ বলে না, কেউ দেখে না। আমি লিখছি, ছবি তুলছি কারণ-আমরা শুধু সংবাদদাতা নই, আমরা এই সমাজের না বলা কথার কণ্ঠস্বর। আমি লিখছি, ছবি তুলছি কারণ-আমার লেখা, আমার ছবি সেই না বলা কথাগুলোকেই তুলে ধরার চেষ্টা। এটা কারো বিরুদ্ধে নয় বরং যারা এই পেশায় আছে কিংবা একে দেখতে চায় ভেতর থেকে—তাদের জন্য।
সম্পাদক ও প্রকাশক:- গজনবী বিপ্লব
নেত্রকোণা অফিস:- গজনবী ভিলা, সাতবেরিকান্দা, নেত্রকোণা সদর, নেত্রকোণা